১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানিকগঞ্জে বজ্রপাতে পাঁচ বছরে মৃত্যু শতাধিক

-

বেড়েই চলছে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা। কয়েক বছর ধরে মানিকগঞ্জে বজ্রপাতের হার বেড়ে গেছে আগের তুলনায় ৩ গুণ। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে শিল্পায়ন ও নগরায়ন। এরই প্রভাবে অতিমাত্রায় বাড়ছে নাইট্রোজেন, সালফার ও কার্বন গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ। ফলে বাড়ছে বজ্রপাতের ঘটনা।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, ইউনিয়ন পরিষদ ও বেসরকারি পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা বারসিক এর তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যানে, গত ৫ বছরে জেলার ৭টি উপজেলায় বজ্রপাতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১২৫ ব্যক্তি। মারা গেছে অনেক গবাদিপশু, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা, পরিবেশ-প্রকৃতি। বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কমপক্ষে দুই শতাধিক মানুষ। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেকেই। বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই মাঠে কাজ করা কৃষি শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা।
গত ৬ জুন রোববার সন্ধ্যায় হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের সাথে বৃষ্টির সময় এক বজ্রপাতে ৪ জন নিহত হয়েছে। ঘিওর উপজেলায় ৩ জন ও দৌলতপুরে ১ জন নিহত হয়। এ সময় আহত হয় আরো ২ কৃষি শ্রমিক। আহত ২ ব্যক্তিকে ঘিওর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের দু’জনেরই কান ফেটে রক্ত ঝরছিল।
জানা গেছে, জেলার দৌলতপুর উপজেলার বাঁচামারা ইউনিয়নের চরভাঙ্গাগ্রামের মহিষের গাড়িচালক গোলাম মোস্তফা (৪০) বাদাম বোঝাই করে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ ঝড়ের সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। তিনি চরভারাঙ্গা গ্রামের আব্দুল বাতেনের ছেলে। এদিকে ঘিওর উপজেলার চরবৈলট গ্রামের মুক্তার মিয়ার ছেলে শাহীন মিয়া (১৮) ধান কাটতে গেলে বজ্রপাতে মারা যায়। সে মহাদেবপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর প্রথম বর্ষের ছাত্র। বিকেলে তাদের জমির ধান কাটা শেষ করে বাড়িতে আসার সময় বজ্রপাতে নিহত হয়। অপরদিকে উপজেলার ঠাকুরকান্দি গ্রামের আর্শেদ মিয়ার ছেলে জুলহাস মিয়া জুলু (২৮) এবং কুস্তা গ্রামের মো: লতিফ মিয়ার ছেলে মো: ইবাদুল (৩০) তার বাঙ্গী ক্ষেতে কাজ শেষে তারা গোসল করতে যায়। একপর্যায়ে বাড়িতে ফেরার সময় বজ্রপাতে তারা ২ জন নিহত হয়। তার বাড়িতে কাজ করতে আসা ওয়াসিম (৩০) মারাত্মক আহত হয়। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার খারবাথারা গ্রামে।
গত ১৮ মে বজ্রপাতে কৃষকসহ দুই ব্যক্তি মারা যায়। জেলা সদর ও ঘিওর উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। এদের একজন দিনমজুর আজিমত আলী, অপরজন স্থানীয় রাকিব আহম্মেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসিফ। বজ্রপাতে আসিফের বন্ধু আব্দুল্লাহ ও অনিক আহত হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
২০২০ সালের ৬ জুন মানিকগঞ্জে বজ্রপাতে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যু হয়। এ সময় আরো চারজন আহত হয়েছেন। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা শহরের পোড়রা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
২০২০ সালের ৯ মে জেলার সাটুরিয়া উপজেলায় বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত দুই কৃষক উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মৃত, তোয়াজের ছেলে মো: তারুণ (৫৫) এবং মো: জব্বর আলীর ছেলে মো: সেলিম (৩২) ।
২০১৯ সালের ১০ মে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে বজ্রপাতে সাইফুল ইসলাম আঙ্গুর (১২) নামে এক স্কুলছাত্রসহ দুইজন নিহত হয়েছে। সে তালুকনগর উচ্চবিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। স্কুলের শিক্ষার্থীরা মধ্যাহ্ন বিরতিতে বিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে চানাচুর-বিস্কুট খাচ্ছিল। এ সময় বজ্রপাতে বিভিন্ন শ্রেণীর ১১ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। মারাত্মকভাবে আহত সাইফুল ইসলাম আঙ্গুরকে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়।
২০১৮ সালের ২৮ মে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ও সাটুরিয়া উপজেলায় বজ্রপাতে দুই শিশুসহ নিহত হয়েছেন পাঁচজন। নিহতরা হলেন, সিঙ্গাইরের জামালপুর গ্রামের নজগর আলীর ছেলে তাহের (৪০), একই গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে আব্দুল বারেক (৪৫), রওশন আলীর ছেলে আসলাম হোসেন (৪০) ও সাটুরিয়ার হরগজ চরপাড়া গ্রামের মৃত গণেশ চন্দ্র সরকারের ছেলে জয়ন্ত চন্দ্র সরকার (১২) ও মৃত গোবরধনের ছেলে নিতাই চন্দ্র সরকার (১৬)। জয়ন্ত সরকার স্থানীয় হরগজ চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ও নিতাই সরকার স্থানীয় হরগজ শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র।
২০১৭ সালের ২৪ মে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জায়গীর এলাকায় আবদুস সালাম (৫৫) নামে এক কৃষক বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির পাশের মাঠে গরু আনতে গেলে তিনি বজ্রপাতের কবলে পড়েন। একই সময় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন শিবালয় উপজেলার তারাইল গ্রামের মোশারফ হোসেনের স্ত্রী। ওই বছরের ২১ এপ্রিল বিকেলে মানিকগঞ্জের ঘিওরে বজ্রপাতে সুভা বেগম (৫৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ১৯ জুন মানিকগঞ্জের শিবালয়ে বজ্রপাতে রুহুল শেখ (৯) নামের এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। একই বছরে ঘিওর উপজেলার শ্রীধরনগর ও বেগুন নারচি গ্রামে বজ্রপাতের পৃথক দুটি ঘটনায় ২ কৃষক নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন উপজেলার শ্রীধরনগর গ্রামের মৃত ফয়জুদ্দিন সর্দারের ছেলে সামেজ উদ্দিন সর্দার ও বেগুননাটি গ্রামের জাবেদ আলী মন্ডলের ছেলে ঠান্ডু মন্ডল।
২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে বজ্রপাতে মনির হোসেন নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
ওই বছরের ১৩ জুন মানিকগঞ্জে সদর উপজেলার বারাহিরচর এলাকায় বজ্রপাতে আব্দুল হালিম (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ৬ জুন জেলার ঘিওর উপজেলার গোয়ালডাঙ্গি ও তারাইল গ্রামে বজ্রপাতে ২ নারীর মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন গোয়ালডাঙ্গি গ্রামের চায়না আক্তার (৩২) ও তারাইল গ্রামের বিলকিস বেগম স্বপ্না (৪৫)।
পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জী বলেন, এ অঞ্চলে একসময় প্রচুর তাল, খেঁজুর এবং বড় বড় বট পাইকড়সহ নানা জাতের গাছের বৈচিত্র্য ছিল। দিনে দিনে এসব কমে যাবার ফলে বজ্রপাতের হার বেড়েছে। গাছপালা কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে জলাভূমিগুলো কমে যাবার কারণে বজ্রপাত হচ্ছে। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানি হচ্ছে।
পরিবেশ বিষয়ক উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ‘বারসিক’ এর মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, বজ্রপাতে নিজে সতর্ক থাকা এবং অন্যকেও সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়া উচিত। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর পরিমাণে তাল, খেজুর এবং দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে বড় বড় গাছসহ তাল এবং খেজুর গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement