২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
ভার্চুয়াল আলোচনায় বক্তারা

সরকার নিজেই তামাক শিল্পের সাথে মিশে আছে

-

কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ালে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। তবে এর জন্য আগে সরকারকে তামাক কোম্পানিতে তাদের থাকা শেয়ার ছেড়ে দিতে হবে। কারণ সরকার নিজেই তামাক শিল্পের সাথে মিশে আছে বলে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের অভিমত। তারা বলেন, আমরা প্রতি বছরই সরকারের কাছে দাবি জানাই তামাকের কর বাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমরা প্রতি বছরই সরকারের কাছে দাবি জানাই তামাকের কর বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন দেখি না। তারা বলেছেন, তামাক-কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে বিএটিবিতে সরকারের অংশীদারিত্ব এবং এনবিআরে তামাক কোম্পানির প্রভাব।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স- আত্মার যৌথ উদ্যোগে গতকাল সোমবার ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে অর্থনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাসসের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। বক্তব্য রাখেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং অনারারি প্রেসিডেন্ট, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল, দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে) বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো: মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা: সৈয়দ মাহফুজুল হক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন, আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরন। বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
প্রজ্ঞার পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সঠিকভাবে করারোপ করা হলে প্রায় ১১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। ৩ লাখ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং ৪ লাখ তরুণের অকাল মৃত্যুরোধ হবে। সিগারেট থেকে সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ও ভ্যাট বাবদ অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সরকার নিজেই তামাক শিল্পের সাথে মিশে আছে। বিএটিতে সরকারের শেয়ার আছে। আর সেটা রাষ্ট্রপতির নামে। আবার কম শেয়ার থাকলেও সেখানে ৫০ শতাংশ পরিচালকই সরকারি পরিচালক। তিনি বলেন, কিছু ট্যোবাকো কোম্পানি অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে না পেরে বাংলাদেশে করছে। কারণ এখানে সম্ভব বলেই এসেছে। তামাক নীরব ঘাতক। যারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রতি বছরই সরকারের কাছে দাবি জানাই তামাকের কর বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন দেখি না। আমাদের সংবিধানে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। আর রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, তামাকের দাম বাড়ানো হলে গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এনবিআরের এই বক্তব্য খুবই হতাশাজনক। বরং তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তিনি বলেন, তিনটি দিকে আমরা পিছিয়ে আছি। তামাক রফতানিতে আগে ২৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে করে তামাক উৎপাদনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিএটিতে সরকারের শেয়ার আছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এটা সরকারকে ছেড়ে দিতে হবে। তিনি এ বছরের তামাক-কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব সমর্থন করে তামাকের রফতানি শুল্ক পুনর্বহালেরও দাবি জানান। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমি আশা করি এবারের বাজেট প্রণয়নের সাথে যারা যুক্ত আছেন তারা তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধির এই দাবি কিছু না কিছু পূরণ করবেন। এর পাশাপাশি তিনি নতুন প্রজন্মকে তামাক থেকে দূরে রাখার জন্য পাঠ্যক্রম এবং সহশিক্ষা পাঠ্যক্রমে তামাকের কুফল অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, তামাক-কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে বিএটিবিতে সরকারের অংশীদারিত্ব এবং এনবিআরে তামাক কোম্পানির প্রভাব। আগামী বাজেটে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তামাক কোম্পানিতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কর বৃদ্ধি করে সিগারেটের সহজলভ্যতা যদি কমানো যায় তাহলে বিশেষ করে যারা দরিদ্র মানুষ তারা এই অর্থ পুষ্টিকর খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারবে। তিনি তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, কর বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি সেখানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বেশি কাজ করতে হবে। কিন্তু সেটি আমরা দেখছি না। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বিড়ি-সিগারেট ব্যবহারের কারণে লোকজন অসুস্থ হয় এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে এবং এ কারণে দারিদ্র্য আরো বাড়েÑ এই বিষয়ে বেশি প্রচারণা এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডা: সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, আমরা তামাকপণ্যে কর বাড়াতে চাই কারণ এতে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এসব পণ্যের সহজলভ্যতা কমে এবং তরুণরা তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয়। এ ছাড়াও তামাক ইন-ইলাস্টিক জাতীয় পণ্য হওয়ায় কর বাড়ালে সরকারের রাজস্ব বাড়বে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, নিম্ন স্তরের সিগারেটের ভোক্তা মোট সিগারেট ধূমপায়ীর প্রায় ৭০ শতাংশ। সুতরাং সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে এই স্তরের দাম বাড়িয়ে মধ্যম স্তরের কাছাকাছি নিতে পারলে সিগারেটের ব্যবহার যেমন কমবে তেমনি সরকারের রাজস্ব কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement