২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

টঙ্গীতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ বস্ত্রকল

বারবার আকুতি সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই
-

রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা শ্রমিক মালিকানায় হস্তান্তরের চুক্তিনামা বাস্তবায়ন না হওয়ায় টঙ্গী শিল্প এলাকায় অবস্থিত চারটি বৃহৎ বস্ত্রকলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত কোম্পানি না পারছে কারখানাগুলো চালাতে, না পারছে রক্ষণাবেক্ষণ করতে। ব্যাংক ঋণের সুবিধা না পাওয়ায় সম্ভাবনাময় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান আর্থিক সঙ্কটে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিগত ২০ বছর আগে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন বা বিটিএমসির রেখে যাওয়া পুরনো যন্ত্রাংশগুলো মরিচা খসে পড়ছে। মাকড়সার জাল, ধুলাবালু, পোকা মাকড়ের আস্তানায় পরিণত হয়ে কারখানাগুলোতে ভুতুরে অবস্থা বিরাজ করছে। সার্ভিস চার্জ ভিত্তিতে আংশিক সচল রাখা কারখানা নিউ অলিম্পিয়া ও নিউ মেঘনা টেক্সটাইল মিলেরও এখন ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। নিউ মন্নু টেক্সটাইল ও মন্নু ফাইন কটন মিল সমন্বয়ে গঠিত নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলস লি. ইতোমধ্যে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। মিলগুলো রক্ষার ব্যাপারে শ্রমিক মালিকানায় গঠিত কোম্পানি কর্তৃপক্ষের বারবার আকুতি সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।
বিগত ২০০০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বস্ত্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘শ্রমিক-কর্মচারীদের নিকট রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বস্ত্র মিলের মালিকানা হস্তান্তর (পদ্ধতি ও শর্তাবলী) নীতিমালা’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপনের ১৪নং কলামে উল্লেখ করা হয়, ‘হস্তান্তরিত মিলের পরিচালনা ও বিএমআরই কার্যক্রম অর্থায়নের জন্য ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সংগ্রহের বিষয়ে প্রচলিত আর্থিক নিয়মনীতির আলোকে সরকার মিল গ্রহীতা শ্রমিক-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত কোম্পানিকে সহযোগিতা দিবে।’ এ ছাড়া হস্তান্তর চুক্তিনামার ৪ নং শর্তেও বলা হয়েছে ‘উল্লেখিত ন্যস্তকৃত প্রতিষ্ঠানের স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির পরিচালনা ও বিএমআরই (ইধষধহপরহম, গড়ফবৎহরুধঃরড়হ, জবযধনরষরঃরড়হ/জবঢ়ষধপবসবহঃ ধহফ ঊীঢ়ধহংরড়হÑ ভারসাম্যকরণ, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন/প্রতিস্থাপন ও সম্প্রসারণ) কার্যক্রম অর্থায়নের জন্য ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সংগ্রহের বিষয়ে প্রচলিত আর্থিক নিয়মনীতির আলোকে প্রথম পক্ষ দ্বিতীয় পক্ষকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবে।’ কিন্তু এই শর্ত অনুযায়ী বিগত ২০ বছরেও প্রথম পক্ষ বা সরকারি পক্ষ কোনো সহযোগিতা করেনি বলে মিলগুলোর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ শ্রমিক মালিকানার কোম্পানি বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মিলগুলো পরিচালনায় শ্রমিকদের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় এবং ব্যাংক ঋণের সুবিধা গ্রহণে সরকারপক্ষ তাদের বঞ্চিত করায় শত চেষ্টা করেও তারা মিলগুলো সচল রাখতে পারেননি।
এসব মিলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ জানায়, মিলগুলো শ্রমিক মালিকানায় হস্তান্তরের আগে দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। ফলে দীর্ঘ দিনের অকেজো মেশিনগুলোকে নিজস্ব অর্থায়নে মেরামত করে কোনোমতে চালু করা হয়। কিন্তু শ্রমিকদের কার্যকরী প্রয়োজনীয় মূলধন না থাকায় তারা নিজস্ব প্রক্রিয়ায় উৎপাদন কার্যক্রমে যেতে পারেননি। অপর দিকে তারা মিলের পূর্ণাঙ্গ মালিকানা লাভ না করায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সিসি লিমিট ব্যবস্থা বা ঋণ গ্রহণের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন। এ অবস্থায় তারা ভাড়ায় বা সার্ভিস চার্জ ভিত্তিক কারখানাগুলো সচল রাখার চেষ্টা চালান। কিন্তু ৫০ ও ৬০ দশকের পুরনো মডেলের মেশিন দিয়ে তারা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি। এ ছাড়া এসব মেশিনে উৎপাদিত পণ্য (সুতা) নিম্নমানের হওয়ায় সার্ভিস চার্জ পার্টিও একপর্যায়ে আগ্রহ হারিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। উপায় না পেয়ে কারখানাগুলোর সুতা উৎপাদন প্রক্রিয়া তারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলস লি. দীর্ঘ দিন যাবৎ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় মিলটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে কিছু নতুন মেশিন সংযোজন করে নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল ও নিউ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের শুধু ডায়িং বিভাগ এখনো কোনোমতে চালু রয়েছে।
নিউ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের চেয়ারম্যান জাহিদ আল মামুন জানান, তাদের কারখানায় বিটিএমসির রেখে যাওয়া ৬০ দশকের পুরনো ১৭৬টি তাঁত মেশিন মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ডায়িং বিভাগ ছাড়া অন্যান্য সব বিভাগ আরো বহু আগেই ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়েছে। তবে তারা বহু কষ্টে নতুন একটি অটো ড্রইং মেশিন, দু’টি অটোকোন মেশিন, একটি হিট চেম্বার, তিনটি গভীর নলকূপ ও ইটিপি প্লান্ট স্থাপন করে ডায়িং বিভাগ চালু রেখেছেন। ডায়িং বিভাগের পুরনো মেশিনপত্রগুলো দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে সচল রাখাও আর সম্ভব হচ্ছে না। তবুও তারা এভাবে বিগত ২০ বছরে মিলটি পরিচালনা করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি টাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছেন। শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে ৩৫ কোটি টাকার বেতন দিয়েছেন। এ ছাড়া ৫৫ লাখ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর এবং ৪৩ লাখ টাকা পৌরকর পরিশোধ করা ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন সরকারি ট্যাক্স পরিশোধ করে আসছেন। ব্যাংকে তাদের আরো ৫০ লাখ টাকা জমা আছে এবং এফডিআর হিসাবে আরো ১৫ লাখ ৩৯ হাজার টাকা জমা আছে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার কিস্তি পরিশোধ ছাড়াও ভাণ্ডারে রক্ষিত মালামালের মূল্য বাবদ ৪৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার মেয়াদি লোন পরিশোধ করেছেন। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ইটিপি (ঊভভষঁবহঃ ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা) প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন। আরো প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সব ভবন, মসজিদ, বাউন্ডারি, রাস্তা সংস্কার করেছেন। প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে পানির নিষ্কাশন হাউজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে চারতলা কলোনি ভবন সংস্কারকাজ চলমান আছে। প্রতি বছর ১০০% হারে শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বোনাস প্রদান করা হয়। যা এ যাবৎ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, মিলটি হস্তান্তরের সময় অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। স্থাবর-অস্থাবরসহ প্রত্যেকটি জিনিসের মূল্য তিন থেকে চারগুণ হিসেবে ধরে বুকভ্যালু তৈরি করে আমলাতান্ত্রিক কায়দায় মিলের মালিকানা তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিটিএমসির রেখে যাওয়া ৪০ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ চক্রবৃন্দ হারে সুদে-আসলে ১৪২ কোটি টাকা নির্ধারণ করে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশাল অঙ্কের এই সুদ মওকুফ করে দিলে তারা আরো আগেই আসল ঋণ পরিশোধ করে মিলের পূর্ণ মালিকানা লাভ করতে পারতেন বলে জানান।
তিনি বলেন, শ্রমিকরা যাতে মিলগুলো চালাতে পারে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে। শ্রমিকদের দ্বারা মিলগুলো কিভাবে চালানো যায় সেজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে প্রত্যেক মিল কর্তৃপক্ষের সাথে আলাদা বৈঠক করে সবার মতামতের ভিত্তিতে সুপারিশ পেশ করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তারা ভালো কিছু আশা করছেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
নিজের প্রসঙ্গে জাহিদ আল মামুন জানান, মিলটিতে তার বড় ভাই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তিনি করণিক হিসেবে মিলে চাকরি নেন। তখন তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। চাকরিতে নিয়োজিত থেকেও তিনি ১৯৮৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিগত ২০০১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে কোম্পানির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং কোম্পানির মেমোরেন্ডামের শর্তানুযায়ী যোগ্যতার ভিক্তিতে তিনি মিলের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় আছেন। বর্তমানে তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। নিয়মতান্ত্রিকভাবে মিল পরিচালিত হচ্ছে এবং মিল পরিচালনা করে তিনি অতিরিক্ত কোনো সুবিধা নেননি বলে দাবি করেন।
এ দিকে মিলটির অপর পরিচালক মো: সালাহ উদ্দিন জানান, তারা অধিকাংশ পরিচালকই নিজ নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের মতোই কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি বলেন, নিজেকে কখনো কর্মকর্তা বা মালিক মনে করি না। নিজের ও স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি ও বাড়ি থেকে অর্জিত আয় দিয়ে অসহায় দুস্থ সাধারণ শ্রমিকদের সাহায্য করার চেষ্টা করি।
এ দিকে নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: মিজানুর রহমান তাদের মিলটিকে একটি পুরনো গাড়ির সাথে তুলনা করে বলেন, সরকার আমাদের একটি পুরনো গাড়ি ধরিয়ে দিয়েছে। গাড়িটি হস্তান্তরের আগে এর পেছনে সরকারের মোটা অঙ্কের যে ঋণ ছিল আমাদের সেই ঋণও পরিশোধ করতেও বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা ঋণ পরিশোধ করব কোত্থেকে। সরকার আমাদের গাড়ির মেরামত ও জ্বালানি খরচ না দেয়ায় এই গাড়ি আমাদের কোনো কাজেই আসছে না। আমাদের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় গাড়িটি আমরা সচল করতেও পারিনি। বর্তমানে এটি স্ক্রেপ হিসেবেও বিক্রি করা যাবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement