২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিটফোর্ড হাসপাতালে পদে পদে রোগী হয়রানি; সেবার নামে প্রতারণা

-

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে পদে পদে রোগী হয়রানি করা হচ্ছে। কিছু ডাক্তার, নার্স ও আউটসোর্সিং পদে কর্মরত স্টাফ রোগীদের জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দোহার, নবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম ঠিকানা হচ্ছে মিটফোর্ড হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগীর চাপ থাকে। বহির্বিভাগ ডাক্তারদের ওপড় চাপ পরে বেশি। কারণ রোগীর তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম। যেখানে একজন ডাক্তার ১৫ থোকে ২০ জন রোগী দেখার কথা, সেখানে দেড় থেকে ২০০ রোগী দেখেন। তাই তারাও এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। হাসপাতালে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও পুরনো ঢাকায় মেডিনোভা ও পপুলার ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীকে পাঠানো হচ্ছে। ৭০ পার্সেন্ট কমিশন পাচ্ছেন ডাক্তার। রোগীকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগী প্রতি এক থেকে তিন হাজার পর্যন্ত কমিশন নিচ্ছেন ডাক্তার। মনির নামে এক রোগী জানান, পেটে ব্যথা নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাই। দুই ঘণ্টা পর টিকিট মিলে। পরে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে, রক্ত, ইউরিন ও মল পরীক্ষা দেয়। তবে হাসপাতালে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়নি। মেডিনোভার একটা কাগজে সব কিছু লিখে দিয়েছেন। প্রায় ৬ হাজার টাকা লাগছে। রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সরবত বিক্রি করেন তিনি। এ দিকে আবার কোনো কোনো ডাক্তার ভুয়া কোম্পানির ওষুধ রোগীর প্রেসক্রিপশন করছেন। এসব ওষুধের মধ্যে ডিব্বা কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থা পত্রে লিখছেন। তার মধ্যে রয়েছে হাইবিট ট্যাবলেট, পিমিও ক্যাপসুল, নাটকল ট্যাবলেট, বাসিল ক্যাপসুল, ক্যালজিম ট্যাবলেট, ওক্সানা ও কিট এমবার সিরাপ প্রভৃতি ভারতীয় নিষিদ্ধ ওষুধ। ২০ থেকে ২৫টি সিন্ডিকেটের ডিব্বা সদস্যরা ডাক্তারদের মেনেজ করে কৌশলে বিক্রি করছে এসব ওষুধ। এসব ওষুধ কিনে সেবন করে আরো বেশি আশঙ্কায় ভুগছে রোগীরা। প্রতারকচক্রকে চিনলেও ব্যবস্থা নিতে পাড়ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ দিকে হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী ও তার স্বজনরা এ প্রতিবেদককে জানান, ভর্তি রোগীদের সাথে ডাক্তার ও নার্স রূঢ় আচারণ করেন। ঢাকা জজ কোর্টের মোড়ে রায়সাহেব বাজারে মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে লোক ডেকে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। না যেতে চাইলে নানা কথা বলে ভয়ভীতি দেখায়। ১ নম্বর ভবনের ৫ তলায় অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডের এক রোগী মুঠোফোনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখান ডাক্তাররা খারাপ আচারণ করে। তার প্রসাবের স্পটে টিউমার হয়েছে এমন কথা বলে ডাক্তার।
অন্য দিকে ওয়ার্ডের নার্সরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করে। হাসপাতালে ওষুধ নেই কেন এমন কথা জানতে চাইলে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় তারা। নতুন ভবনে ৬ তলায় মেডিসিন বিভাগে এক রোগীর স্বজন জানান, নার্সরা বাহির থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করছে। তার বাবার নিউমোনিয়া হয়েছে। প্রতিদিন দুটো করে ইনজেকশন দিতে হয়। একটা ইনজেকশনও হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে না।
এ দিকে ট্রলি ও হুইলচেয়ার, বিছানা ও বালিশ নিয়ে বাণিজ্য করছে চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী একটি সিন্ডিকেট। ট্রলি ঠেললে ২০০ টাকা, বিছানা পেতে ১০০ টাকা এবং বালিশ পেতে ১০০-২০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকছেন রোগী ও তার স্বজনরা। পাঁচ দিন আগে ছিনতাইকারীর কবলে পরে সর্বস্ব হারিয়ে বাবুবাজার ব্রিজের ওখানে পরে ছিল দিপু নামের এক কলেজছাত্র। পরে সিএনজি চালক লিটন তাকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করেন। তিনি পদে পদে হয়রানির কথা জানান। তিনি বলেন, রোগীর কোনো আপনজন নেই বলা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না ট্রলি ও বিছানা সিন্ডিকেট। তাদের ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।
প্রতিদিন প্রায় ৪০০-৫৫০ রোগী এখানে এক্সরে সেবা নিতে আসেন। তবে তাতে রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। ১২টার পরে টাকা জমা নেয় না কোনো রোগীর। এতে ১০০-১৫০ রোগীর এক্সরে করা হয়। তা ছাড়া এক্সরে মেশিন পুরনো হওয়ায় দুই থেকে তিনবারও পরীক্ষা করা হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখানে কর্মরত কিছু কর্মচারী রোগীদের কাছ থেকে ২০০-৩০০ করে নিচ্ছে টাকা। হাসপাতাল কোষাগারে জমা না দিয়ে দিনের পর দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু কর্মচারী। মুরশিদ আক্তার নামে এক রোগী জানায়, এক্সরে বিভাগে নারী টেকনেশিয়ান না থাকায় হয়রানিতে পড়ছেন নারী রোগীরা। শরীরের নানা স্থানে হাত দিয়ে রোগীদের হয়রানিতে ফেলছে পুরুষ টেকনিশিয়ান। এতে রোগীকে আরো বাড়তি রোগে আক্রান্ত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এ বিভাগে গাইনি বিভাগে। গর্ভবতী নারী এলে ঈদের চেয়ে বেশি খুশি হয় আয়ারা। নবজাতককে জিম্মি করে ১৫ শ’ থেকে দুই হাজার টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা। নবজাতক আটকিয়ে চাঁদবাজি ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে নিরাপত্তাকর্মী আনসাররাও।
মিটফোর্ড হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রাশেদুন্নবী নয়া দিগন্তকে বলেন, হাসপাতালে নানান অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মিলছে। তার মধ্যে ওয়ার্ড ডাক্তারদের টেবিলে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাগজ।
এসব ডাক্তারকে কোনো অনিয়ম না করার জন্য বলা হয়েছে। তা ছাড়া ওষুধ কোম্পানির লোকজন ডাক্তারকে উৎপাত করত। তা বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেকটা দালাল মুক্ত করা হয়েছে। এর পরেও যদি কোনো ডাক্তার, নার্স কিংবা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগের সত্যতা মিলে, তাহলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement