২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিদ্যুতের আলোয় ঘরেই রকমারি সবজির চাষ

কৃষিতে আমূল পরিবর্তন
-

সূর্যের আলো ছাড়াই বিদ্যুতের আলোতে ঘরের ভেতরেই হবে কীটনাশকমুক্ত রকমারী সবজির চাষ। ফসলের ক্ষেত কিংবা বাড়ির ছাদ নয়, ঘরের ভেতরেই বিদ্যুতের এলইডি লাইটের আলোতে বেড়ে উঠবে পালং, পুঁইশাক, ঢেঁড়স, মরিচ, বেগুন, টমেটো, চেরি, লেটুস, ক্যাপসিকামসহ আপনার পছন্দের সবজিগুলো।
আগামীর কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা থেকে এমনি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবুল ফজল মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। এ গবেষণা পদ্ধতিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ইনডোর ভেজিটেবল প্রডাকশন’। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিজ উৎপাদনে সূর্যালোকের পরিবর্তে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় আলোক বর্ণালি নির্দিষ্ট করে ঘরেই সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে খেতের সমপরিমাণ ফসল উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, কয়েক বছর থেকেই তিনি এ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তাতে তারা দেখতে পেয়েছেন, সূর্যের আলোতে সাতটি রশ্মি থাকে। বিভিন্ন বর্ণের রশ্মি কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদ তার খাবার তৈরি করে থাকে। ফলে বিভিন্ন রঙের আলো ব্যবহার করে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে ফসল উৎপাদন সম্ভব।
এই গবেষক বলেন, এই পদ্ধতির মাধ্যমে আনুমানিক এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের হলরুমেই আমরা স্তরে স্তরে স্পেকট্রাম টেকনোলজি ব্যাবহার করে ঢাকা শহরের মতো বড় অঞ্চলের সবজির চাহিদাও পূরণ করতে পারব। ২০১৭ সাল থেকে এ গবেষণায় কয়েক রঙের আলো নিয়ে পরীক্ষা করে তারা দেখতে পেয়েছেন সাদা আলোয় সবজি যে পরিমাণ উৎপন্ন হয় নীল আলো ব্যবহারে তার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। এ ছাড়াও লাল আলোতে ফল এর উৎপাদন বাড়ে।
তিনি বলেন, যেহেতু এই কৃষি পদ্ধতিতে সময় নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের মাধ্যমে দিনের দৈর্ঘ্য ও যন্ত্রনির্ভর সেচ ব্যাবস্থা দেয়া সম্ভব তাই সহযোগীর সংখ্যাও কম লাগে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বর্তমানে করোনা মহামারীর মতো যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ সময়েও সম্পূর্ণ নিরাপদে সবজি উৎপাদন ও তা গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
দেশে এ প্রযুক্তির পরিচিত হওয়া নিয়ে অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, বাণিজ্যিকভাবে এটি ব্যবহারে লাভবান হবেন সবাই। কারণ মাঠপর্যায়ে কোনো ফসল উৎপাদনের চেয়ে একই জায়গায় আমরা স্তরে স্তরে চাষে ১০ গুণ পর্যন্ত ফলন পাবো। এ ছাড়াও শ্রমিকের সংখ্যা কম থাকায় এর উৎপাদন খরচও কম হবে।
তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ। ফলে মানসম্মত খাদ্য নিশ্চিতে এটি যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। তাই ছাদের নিচে এলইডি লাইট ব্যবহার করে সবজি বা পণ্য উৎপাদনকে আধুনিক কৃষির সূচনা বলে ধারণা করছেন তিনি।
এলইডি লাইটে সবজি চাষের সুবিধা সম্পর্কে জামাল উদ্দিন বলেন, খোলা মাঠে চাষাবাদ করা সবজিতে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। ফলে ফসলের পরিমাণ আর মান নষ্ট হয়। কিন্তু এলইডি লাইটে চাষ করা সবজি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থাকায় রোগবালাই কম হয়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকার কারণে ব্যবস্থাপনা খুব সহজ হয়। আগাছাও কম হয়।
এই গবেষক জানান, জাতভেদে টমেটোর ফলন ভিন্ন হয়। তবে এলইডি লাইটের নিচে চলা গবেষণায় যে জাতের টমেটোর চাষ করা হয়েছে, তার উৎপাদন জমিতে চাষের সমান পাওয়া গেছে। বারি ১৪ টমেটো চাষ করে গাছপ্রতি ৩ থেকে সোয়া ৩ কেজি টমেটো পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া মরিচ চাষে চার মাসে গাছপ্রতি দেড় থেকে ২ কেজি ফলন পাওয়া গেছে, যা মাঠের ফলনের সমান। বেগুন চাষেও গাছপ্রতি ২ কেজি পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
তার মতে, শহরের জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর। এলইডি লাইটে চাষাবাদের খরচ প্রথম অবস্থায় বেশি হলেও এই খরচে প্রায় ১০ বছর চাষাবাদ সম্ভব। এ ছাড়া এলইডি লাইটে উল্লম্ব পদ্ধতিতে (ভার্টিক্যাল অ্যাগ্রিকালচার) চাষাবাদ সম্ভব। ফলে মাঠে যেখানে এক স্তরে চাষ হয়, উল্লম্ব পদ্ধতিতে সেখানে কয়েক স্তরে চাষ করা সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে পাত্রের মধ্যে কোকোডাস্ট, বেলে-দোআঁশ মাটি ও কেঁচো সার দিয়ে সবজি লাগানো হয়। এরপর পরিমাণমতো আলোর এলইডি লাইট দিয়ে গাছে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা তৈরি না হওয়ায় এলইডি বাল্বগুলো গাছের খুব কাছাকাছি দিলেও সমস্যা হয় না।
জামাল উদ্দিন জানান, গবেষণার প্রথম দিকে শুধু সাদা এলইডি লাইট ব্যবহার করে দেখা গেছে, এতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হলেও ফলন কম হচ্ছে। পরে সাদা লাইটের সঙ্গে নীল বর্ণের লাইট যোগ করে দেখা যায় পাতাজাতীয় সবজি ভালো বাড়ছে। কিন্তু ফলজাতীয় সবজিতে তেমন ফলন পাওয়া যায়নি। পরের বছর সাদা ও নীল লাইটের সঙ্গে লাল লাইট দেয়া হয়। তাতে টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ ও স্ট্রবেরির ফুল ও ফলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে।
তবে এলইডি লাইটে চাষের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই গবেষক। যেমন লাইট জ্বালিয়ে রাখার সময়সীমার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে গাছকে আলোতে রাখার সময়সীমা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এলইডি লাইটের আলো টাইমারের (সময় নিয়ন্ত্রণযন্ত্র) মাধ্যমে ঠিক করে দেয়া উত্তম। এলইডি লাইটের মাধ্যমে ছাদের নিচে চাষাবাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, এ পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় খাবারের একটা বড় অংশ উৎপাদন সম্ভব।
গবেষকরা জানান, দীর্ঘ গবেষণার পরে এসেছে কাক্সিক্ষত সফলতা। অতিরিক্ত পরিশ্রমবিহীন অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক এই পদ্ধতিতে সবজিগুলোকে সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রায় ১২-১৪ ঘণ্টা আলো সরবরাহ করতে হয়। তবে নিয়মিত পানি দেয়ার মাধ্যমে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই মাটির আর্দ্রতা শুকিয়ে না যায়। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি জৈব পদ্ধতি হওয়ায় টবের মাটিতে বাড়তি কোনো সার প্রয়োগ না করে পরিমাণমতো জৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
তবে এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো সবজিগুলোতে পোকামাকড় কিংবা রোগবালাইয়ের আক্রমণ না থাকায় সূর্যের আলোতে সবজিগুলো যতটা না তরতাজা হয়, তার চেয়ে বেশি তরতাজা হয়ে বেড়ে ওঠে কৃত্রিম আলোতে। তাই সবজিগুলোতে কীটনাশক ও পেস্টিসাইড প্রয়োগেরও দরকার পড়ে না।
ড. জামাল বলেন, ‘রাজধানীর সবজির চাহিদার প্রায় পুরোটাই মেটানো হয় গ্রামাঞ্চলের উৎপাদন দিয়ে। এতে পরিবহনের সময় অনেক সবজি নষ্টের পাশাপাশি গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি রাজধানীতে এই পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করি তা হলে মাঠে উৎপাদিত সবজির ওপর চাপ কমিয়ে শহরভিত্তিক কম খরচে জৈব ও স্বাস্থ্যকর সবজি উৎপাদন করা সম্ভব।
পারিবারিকভাবে এ পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদনের সম্ভাবনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো বাসার ছোট একটি কক্ষ, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না বা অব্যবহৃত কক্ষে এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে পুরো পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
গবেষকদের মতে, এই পদ্ধতি অনেকটা শীতপ্রধান দেশগুলোয় চাষ হওয়া গ্রিনহাউজ পদ্ধতির কাছাকাছি হলেও ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য সবজির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’

সকল