২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পর্যটন খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা

চাকরি হারাবেন ৩ লাখ কর্মী
-

করোনাভাইরাসের কারণে মুখ থুবড়ে পড়া পর্যটন খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি ও তিন লাখ কর্মীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা এ খাত রক্ষায় রফতানি খাতের মতো সরকারি আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছেন তারা। অন্যথায় এ খাত ব্যাপক হুমকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ শাখার মহাসচিব তৌফিক রহমান জানান, ‘২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এয়ারলাইনার, ট্রাভেল ও ওমরাহ হজ এজেন্টসসহ পুরো পর্যটন খাতে সামগ্রিকভাবে তারা প্রায় ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার লোকসানের আশঙ্কা করছেন। শুধু সরাসরি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনই নয়, কর্মসংস্থানেও কোভিড-১৯ ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসবে। ফলে সংশ্লিষ্ট খাতের ৩ লক্ষাধিক কর্মী চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি। এয়ারলাইনস, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ট্যুর অপারেটর, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্র্যাভেল এজেন্ট, ওমরাহ এজেন্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ট্রান্সপোর্টসহ পর্যটন খাতের বিভিন্ন অংশের টার্নওভারের একটি পরিমাণ হিসাব করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
অন্য দিকে বিশ^ পরিস্থিতি নিয়ে ডব্লিউটিটিসি বলছে, করোনার বিস্তৃতির সাথে সাথে পর্যটন খাতে চাকরি হারানোর ঝুঁকিও বাড়ছে। গত দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে চাকরি হারানোর এই ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
ডব্লিউটিটিসি অঞ্চলভিত্তিক পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে, মহামারীর সবচেয়ে প্রভাব পড়বে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পর্যটনশিল্পে। এ অঞ্চলের দেশগুলোয় প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ কর্মহীন হতে পারে। ক্ষতি হতে পরে ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এরপর বেশিসংখ্যক মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছে, যথাক্রমে আমেরিকায় প্রায় এক কোটি দুই লাখ, ইউরোপে প্রায় এক কোটি এক লাখ, আফ্রিকায় প্রায় ৪০ লাখ ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ১৮ লাখ পর্যটনকর্মী।
সংস্থাটি অঞ্চলভিত্তিক ঝুঁকির সাথে বেশিসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হতে পারেÑ এমন কিছু দেশের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। যেমন আমেরিকার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতেই পর্যটনসংশ্লিষ্ট ৭০ লাখ কর্মী চাকরি হারাতে পারে। এ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের পর্যটন খাতের বেশিসংখ্যক কর্মী চাকরি হারাতে পারে।
বিরাজমান ভয়াবহ এ পরিস্থিতিকে দেশের অ্যাভিয়েশন শিল্পের জন্য ‘মহাবিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করলেন অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সাধারণ সম্পাদক ও নভো এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের অ্যাভিয়েশন শিল্পে করোনাভাইরাস শুধু বিপর্যয় নয়, ‘মহাবিপর্যয়’ ডেকে এনেছে। এ অবস্থায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি থেকেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকলে দেশে দেশে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে ভ্রমণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসহ পর্যটন খাতে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান অবস্থায় এর থেকে উত্তরণে সরকারের যেসব পদক্ষেপ ব্যবসাটি পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়েও তারা আলোচনা করেছেন। এতে দেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, ট্যুর অপারেটর, পর্যটক যানবাহন ও জাহাজ ও বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি করা হয়। এর পাশাপাশি লোকসান থেকে পর্যটন খাতের পুনরুদ্ধারের জন্য ২০০০ কোটি টাকার সুদমুক্ত ঋণের বন্দোবস্ত করার জন্যও সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশ পর্যটন খাতে আনুমানিক লোকসানের প্রতিবেদনটিও জমা দেয়া হয়েছে।
তবে পাটা বাংলাদেশের এই হিসাবে কেবল সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাত অন্তর্ভুক্ত। সরকারি খাত যুক্ত হলে লোকসানের অঙ্কটা আরো বাড়বে। এতে জানানো হয়, এতে কেবল বেসরকারি খাত থেকে ব্যবসায়ের ক্ষতি অনুমান করে তা করা হয়েছে। সরকারের মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনস (বিপিসি) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের আউটলেট এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা বিভিন্ন প্যাকেজ বরাদ্দের পাশাপাশি অপারেশন পুনরায় শুরু না হওয়া পর্যন্ত ইউটিলিটি বিলগুলো মওকুফ করার অনুরোধ জানান।
জানা গেছে, সঙ্কট মোকাবেলায় পর্যটন সংশ্লিষ্টদের কী ধরনের প্রণোদনা প্রয়োজন তা জানতে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের (বিটিবি) প্রধান নির্বাহী প্রধানের নেতৃত্বে একটি ১৪ সদস্যের পর্যটন সঙ্কট পরিচালনা কমিটি গঠন করেছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ বলেন, করোনার কারণে ভরা মৌসুমে পর্যটন খাতে বিপর্যয় এসেছে। এ কারণে দেশের পর্যটনের বৃহত্তম মেলা দশম শেয়ারট্রিপ বাংলাদেশ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ফেয়ার (বিটিটিএফ) পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ৩ থেকে ৫ এপ্রিলের পরিবর্তে তা ২৯ থেকে ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো: রাফেউজ্জামান জানিয়েছেন, পর্যটন মৌসুমে বাংলাদেশে সাড়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা লেনদেন হয়। কিন্তু পর্যটনের ভরা মৌসুমে করোনার প্রাদুর্ভাব হওয়ায় এবার ক্ষতির মুখে পড়েছে এ খাত। তেমনি ঝুঁকিতে আছেন পর্যটন খাতের কর্মীরা।
অন্য দিকে পর্যটন খাতকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী বরাবর বিশেষ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ জানান, বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোয় প্রত্যক্ষভাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কর্মী নিয়োজিত। পর্যটনের ভরা মৌসুমে করোনার কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকায় তারা এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি ভাবছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে, সরকারি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সসহ জেলার সব ক’টি পর্যটন স্পট ও আবাসিক হোটেল-মোটেল। এসব পর্যটন স্পট ও হোটেল-মোটেল এখন জনশূন্য।
প্রভাব পড়েছে রেস্টুরেন্ট ও খাবার হোটেলেও। বেকার হয়ে পড়েছেন, জেলার পর্যটনসহ হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের অধিক লোকসমাগম এবং পর্যটন এলাকায় ভ্রমণে বিরত থাকার নির্দেশনার পাশাপাশি সতর্কতা অবলম্বনে নিজেরাই ঘোরাঘুরি বন্ধ করে দিয়েছেন দেশের মানুষ। বাতিল করেছেন পূর্বনির্ধারিত সফরসূচিসহ অগ্রিম বুকিং। ফলে এ খাতে এখন হাহাকার বিরাজ করছে।


আরো সংবাদ



premium cement