২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষমতা পেতে একাট্টা ডিসিরা

মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ৩৫ জনের চিঠি
-

সারা দেশে মাদরাসায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ, সুপার ও কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে নিয়োগ কমিটিতে মাঠ প্রশাসন অর্থাৎ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা মোতাবেক গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়।
আদেশে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীসহ সব পদে নিয়োগের জন্য নিজ নিজ জেলার জেলা প্রশাসক মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হবেন/মনোনয়ন দেবেন। এর এক মাসের মাথায় ওই আদেশটি বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক সফিউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত আদেশে গত ১৯ মার্চ আরেকটি আদেশে বলা হয়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের আদেশটি বাতিল করে আবার ডিজির প্রতিনিধিরাই নিয়োগ বোর্ডে থাকবেন। তবে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যথারীতি শিক্ষার মান উন্নয়নে মাদরাসাগুলো পরিদর্শন করবেন।
এক মাসের ব্যবধানে আগের আদেশ বাতিল হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসকরা। গত দুই দিন অন্তত ৩৫ জেলার ডিসি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিবের কাছে স্থানীয় প্রশাসনকে ডিজির প্রতিনিধি করার আদেশটি পুনর্বহাল করার জন্য চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। আদেশটি বাতিল করে নিয়োগপ্রক্রিয়া জেলা প্রশাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবকে অনুরোধ জানান জেলা প্রশাসকরা।
ডিসিদের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে বসার উদ্যোগ নেয়া হবে। কারণ জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ বোর্ডে রাখার সিদ্ধান্তটি ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মুনসী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, ডিসিরা আগের আদেশটি পুনর্বহাল চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাথে বসে এটার সমাধান খোঁজা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডিসিদের এমন চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছেন কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মতামত দেননি মন্ত্রী। ইস্যুটি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে অস্বস্তি চলছে।
জেলা প্রশাসকরা তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নিয়োগে জেলা প্রশাসকদের প্রতিনিধি রাখার আদেশ দেয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে জেলা প্রশাসক নিয়োজিত প্রতিনিধি বাতিল করা হলে স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে, তা ছাড়া নিয়ম ও দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চিঠিতে আরো বলা হয়, অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিয়োগের কাজের দায়িত্ব পালন যেমন সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য; তেমনি তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যত্যয় ঘটবে এবং তাদের অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে, যা সরকারি কাজের প্রচলিত নীতিমালার পরিপন্থী। ঢাকা থেকে মনোনয়ন দেয়া কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলায় গেলে অতিরিক্ত ব্যয় ও সরকারি অর্থের অপচয় হবে।
লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর চিঠিতে বলেন, মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাধারণত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই হয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে তার পছন্দমতো ব্যক্তিকে নিয়োগের চেষ্টা করেন। অধিদফতর থেকে আগত কর্মকর্তারা প্রভাবশালী সভাপতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন না। ফলে স্বচ্ছ নিয়োগকার্যক্রমে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাবে অনিয়ম হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়োগ কমিটিতে থাকলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির অনিয়মের জন্য চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পাবেন না। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাই স্বচ্ছতার স্বার্থে নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি থাকলে এখানে স্বচ্ছতা আসবে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এ আদেশের ফলে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে আবার বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি বাড়বে। জেলা প্রশাসন মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হওয়ার নির্দেশনা দেয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগকার্যক্রম পালন করার কারণে এক মাসেই স্থানীয়দের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল।
বরিশালের ডিসি এস এম অজিয়র রহমান তার চিঠিতে বলেন, আমাদের দেশে উগ্রবাদ ও চরমপস্থা একটি মারাত্মক সমস্যা। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে তা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আবার তা বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে। উগ্রবাদ দমনে অতীতে জেলা প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেক সময় মাদরাসাগুলো থেকে উগ্রবাদ বিস্তার রোধে মাদরাসার প্রশাসনিক পদসহ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। জেলা প্রশাসন নিয়োগ কমিটিতে থাকলে এ বিষয়টি স্থানীয়ভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসকরা সম্পৃক্ত থাকলে সরকারের বিভিন্ন গৃহীত নীতি ও পরিকল্পনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে সহজতর হয়।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক তার চিঠিতে বলেন, দেশের বেশির ভাগ মাদরাসা অনেকটা স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপক প্রভাব থাকে। তাই নিয়োগের ক্ষেত্রে পর্ষদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখা যায়, যা বিভিন্ন নিয়োগের সময় লক্ষণীয়। এটা কেবল জেলা প্রশাসন পক্ষে রোধ করা সম্ভব। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকার তথা জনপ্রশাসন মস্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হওয়ায় নিয়োগ, পদোন্নতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অন্যাতম ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। তাই মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে মাদরাসা শিক্ষার উৎকর্ষতায় মানোন্নয়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে মাদরাসায় নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনকে সম্পৃক্তকরণ ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তা পরিবর্তন করা যৌক্তিক হয়নি।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মো: শাহরিয়াজ তার চিঠিতে বলেন, মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা আনা না গেলে বর্তমান সরকারের মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের ১৯ মার্চের আদেশ বাতিলপূর্বক এ নিয়োগ প্রক্রিয়া জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
একইভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন মেহেরপুর, ফেনী, কুষ্টিয়া, মাগুরা, গাইবান্ধা, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ অন্তত ৩৫টি জেলার জেলা প্রশাসক। বাকিরা একই দাবি করে চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি বাড়াতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসাÑ এ দু’টি বিভাগ করা হয়। এর আগে মাদরাসা অধিদফতর করা হয়। কিন্তু এ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে মাঠপর্যায়ে কোনো কর্মকর্তা না থাকায় অধিদফতরের কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হতো। এ সুযোগ নিয়ে অধিদফতরের কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যোগ্যপ্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্যদের নিয়োগের সুপারিশ করতেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে আট হাজারের বেশি মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ, তদারকি, এমপিওসহ শিক্ষাকার্যক্রমে স্থবিরতা নিয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিসিরা। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিবকে একটি নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্দেশনায় বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় দু’টি বিভাগে ভাগ হওয়ার পর কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকির জন্য মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা না থাকায় শিক্ষাকার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম তদারকি ও শিক্ষক নিয়োগে প্রতিনিধি ডিসি-ইউএনওদের দিতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদের এমন নির্দেশনা মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তারা বাধার মুখে বাস্তবায়ন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন ১৮ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব। তিনি মহাপরিচালকের বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলে ওই দিনই অধিদফতর নির্দেশনা জারি করে। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে মাদরাসার প্রশাসনিক পদ তথা সহ-সুপার, সুপার, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে অধিদফতরের ডিজির প্রতিনিধিরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিসিদের নিয়োগ বোর্ডে প্রতিনিধি দেয়ার পর তা বাতিল করতে উঠেপড়ে লাগেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান ডিজি পোস্টাল ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি বিরাগভাজন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকরা চাচ্ছেন নিজেদের ক্ষমতা সমুন্নত রাখার স্বার্থে আগের আদেশ বাস্তবায়ন করা হোক।


আরো সংবাদ



premium cement