২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ঝুঁকিতে ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ : শঙ্কায় ২৪ লাখ পরিবার

সারা দেশে বইয়ের দোকানে ধর্মঘট ও স্মারকলিপি প্রদান কাল
-

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ার বেশ কয়েকটি ধারা ও উপধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। তাদের দাবিÑ নতুন শিক্ষা আইনের মাধ্যমে এ খাতে ব্যবসায়ীদের ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। একই সাথে সংশ্লিষ্ট পেশায় নানাভাবে জড়িত ২৪ লাখ পরিবারও তাদের পেশা হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সমিতির নেতৃবৃন্দ শিক্ষা আইনের খসড়ার কয়েকটি ধারা ও উপধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তারা আগামীকাল সোমবার সারা দেশে বইয়ের দোকানে ধর্মঘট এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দেয়ারও কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি মো: আরিফ হোসেন লিখিত বক্তব্যে সমিতির দাবি এবং আগামীকালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে নোট-গাইড ও অনুশীলন বই সম্পর্কে কী আছে আর তারা কী চান সেগুলো সবিস্তারে তুলে ধরেন। আরিফ হোসেন লিখিত বক্তব্যে বলেন, সম্প্রতি শিক্ষা আইনের খসড়ায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব ধারা-উপধারা সংযোজন করা হচ্ছে তা চূড়ান্ত হয়ে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার অবনতি ঘটবে। লেখক, প্রকাশক ও শিক্ষার্থীরা তাদের মুক্তচিন্তা চর্চায় বাধাগ্রস্ত হবেন।
খসড়া আইনটির চারটি ধারায় তাদের আপত্তি সম্পর্কে নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, কোনো প্রকার নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই ও প্রকাশ করা যাবে না। যদি কোনো প্রকাশক এ আইন অমান্য করে নোট বা গাইড প্রকাশ করেন তাহলে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কাজেই আইনটি চূড়ান্ত হলে বই প্রকাশের সাথে যুক্ত আমরা প্রায় ২৪ লাখ পরিবার পথে বসবো। এতে শিক্ষাব্যবস্থারও অবনতি ঘটবে।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, আমরা ছোটবেলায় কি শুধু একটি বই পড়েছি? যে লেখকের বই পছন্দ হয়েছে সেটিই পড়েছি। নানা রকমের বই পড়ে নানা রকম জ্ঞান অর্জন করেছি। এখনো শিক্ষার্থীরা যে বই পছন্দ করে সে বই কিনে পড়ে। এতে তাদের জ্ঞান বাড়ে। কিন্তু এনসিটিবি যদি মাত্র একটি বই নির্ধারণ করে দেয় এবং সেটিই পড়তে হয় তাহলে তো মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটবে না। শিক্ষার্থীরা সীমাবদ্ধ জ্ঞানের মধ্যে আটকে যাবে। কাজেই বই প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে।
সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বলেন, অনুশীলনমূলক গ্রন্থ প্রকাশ ও বিক্রির সাথে অন্তত আটটি পেশার ২৪ লাখ মানুষ জড়িত। এই খাতে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। এসব গ্রন্থ প্রকাশনা বন্ধ করা হলে সরকার এক দিকে শত কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হবে, অন্য দিকে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।
পুস্তক প্রকাশকরা নোট-গাইড বই ও সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইয়ের মধ্যকার পার্থক্যগুলোকেও তুলে ধরেন। তারা বলেন, নোট-গাইড বইয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর আলোকে শুধু পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য সহায়ক বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। অপর দিকে সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইয়ে পর্যাপ্ত অনুশীলনের জন্য বিভিন্ন ধাপে যেমনÑ পাঠ্য প্রশ্ন ও নমুনা-উত্তর, প্রশ্ন ও উত্তরের ব্যাখ্যা, উত্তর-সঙ্কেতসহ প্রশ্ন এবং প্রস্তুতি যাচাইয়ের জন্য উত্তরবিহীন নমুনা প্রশ্ন থাকে। এ ছাড়া সমন্বিত অধ্যায়ের প্রশ্ন, রিভিশন, প্রায়োগিক অভীক্ষার দিকনির্দেশনা, ইত্যাদি ধাপ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিখনদক্ষতা অর্জন করে পরীক্ষার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। নোট-গাইড বইগুলো পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী ও বোর্ড-প্রশ্নের হুবহু সমাধান হিসেবে তৈরি করা হয়; অপর দিকে সৃজনশীল অনুশীলনমূলক বইয়ে পাঠ্যবইয়ের দেয়া সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর নমুনা উত্তর এবং প্রশ্ন ও উত্তরের ব্যাখ্যা দেয়া থাকে, যাতে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল উত্তর লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।
এ দিকে পরীক্ষায় যাতে শিক্ষার্থী প্রশ্নাবলি হুবহু কমন পায় সে উদ্দেশ্যে সীমিতসংখ্যক প্রশ্নের নোট-গাইড বই তৈরি করা হয়। কিন্তু অনুশীলনমূলক বইয়ের উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্তসংখ্যক নমুনা প্রশ্ন চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকশিত করা। এসব প্রশ্ন পরীক্ষায় কমন পাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয় না। আবার নোট-গাইড বইয়ের ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক পড়ার উৎসাহ হারায়। ফলে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও প্রতিভা বাধাগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। অন্য দিকে, অনুশীলনমূলক বইয়ে দেয়া নমুনা প্রশ্নগুলো শিক্ষার্থীর ভাবনার জগৎকে বিস্তৃত করে এবং তারা পাঠ্যবিষয়ের জ্ঞান নতুন পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে তা যাচাইয়ের সুযোগ পায়। নোট-গাইড বই থেকে সরাসরি কমন পড়ার বিশ্বাসে শিক্ষার্থীরা না বুঝে মুখস্থ করার প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। অনুশীলনমূলক বই শুধুই অনুশীলনের জন্য। এসব বইয়ে দেয়া নমুনা প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করে কোনো লাভ নেই।
প্রকাশকদের দাবি, অনুশীলনমূলক বইয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তরের ব্যাখ্যা, উত্তর-সঙ্কেতসহ অভিনব প্রশ্ন, সমন্বিত অধ্যায়ের প্রশ্ন, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শিখনফলের আলোকে বাস্তব পরিস্থিতিযুক্ত উদ্দীপক সব প্রশ্ন ও নমুনা-উত্তর, প্রস্তুতি যাচাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সৃজনশীল প্রশ্ন, পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য মডেল প্রশ্নপত্র, ই-লার্নিংকে উৎসাহিত করার জন্য ইন্টারনেট লিংক ইত্যাদি দেয়া থাকে, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত জ্ঞান লাভে সহায়ক।
অনুশীলনমূলক বই প্রকাশের উদ্দেশ্য জানিয়ে তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে মেধার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যেই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলার জন্য এ পদ্ধতি চালু করা ছিল একটি কার্যকর পদক্ষেপ। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় নোট-গাইড বা অনুশীলনমূলক বই থেকে হুবহু প্রশ্ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সমিতির নেতারা বলেন, এসএসসির প্রশ্ন রিপিট হয়েছে। যদিও সরকার বলেছিল বিগত ১০ বছরের কোনো প্রশ্ন রিপিট হবে না। তাদের ভুলের দায় কোনো প্রকাশনা সংস্থা নেবে না।
নোট-গাইড বা অনুশীলনমূলক বই প্রকাশকরা টাকা দিয়ে শিক্ষকদের চরিত্র নষ্ট করছেন এমন অভিযোগের জবাবে নেতারা বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। আর বইয়ের দামও আগের তুলনায় অনেক কমানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির এসব দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ ওয়েব প্রিন্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বিপণন সমিতি, বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই মালিক সমিতি, বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক সমিতি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পেপার মিল ওনার্স সমিতি, বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ কালি প্রস্তুতকারক সমিতির নেতারা।

 


আরো সংবাদ



premium cement