১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে চলছে নানা অনিয়ম

-

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ স্লেøাগানটি বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে। কারাগার কর্তৃপক্ষও দাবি করছেন, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রতিটি বন্দীকে রাখা হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণে। কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দেখানো হয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ। তবে মুখে এ কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। কারাগারের বন্দী ও স্বজনদের প্রতিনিয়তই এখানে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুরো কারাগারেই চলছে টাকার খেলা আর জমজমাট মাদকব্যবসা। যার যত টাকা ও প্রভাব, কারাগারের ভেতরে তার ততই দাপট। মাদকের রমরমা বাণিজ্যও হয় জেলখানার ভেতরে। টাকাওয়ালারা ঘরের মতো জেলখানাতেও বসবাস করে আরাম আয়েশে। আর যাদের টাকা নেই তাদের কারা কর্তৃপক্ষের কিছু ব্যক্তির নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনা প্রকাশ করে না কেউ। কারণ বেশির ভাগ হাজতিই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, মাদক সংশ্লিষ্ট অথবা অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার যেতে হয় কারাগারে।
সূত্র মতে, একজন হাজতি কারা গেট থেকে প্রবেশের পর থেকেই শুরু হয় কারা কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তার অর্থ আদায়ের সূচনা। এরপর জামিনে বের হওয়া পর্যন্ত হাজতিদের নিয়ে চলে তাদের অর্থবাণিজ্য। যার ফলে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময়ই সংবাদকর্মীদের এড়িয়ে চলেন এবং তাদের সাথে কথা বলার সময় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেন।
হাজতিদের কারাগারে প্রবেশের আগে তাদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করেন কারাগারের কিছু কর্মকর্তা। ওই খাতার নাম হলো ‘পিসি বই’। হাজতি মুখে তার পরিচয় সঠিক বললেও লেখার সময় অনেকটাই ইচ্ছে করে পিসি বইতে ভুল তথ্য লেখা হয়ে থাকে। একজন হাজতির নাম যদি হয় ‘মিজানুর রহমান’ কারা কর্তৃপক্ষ তার নাম লিখবে ‘মিজানুর বহমান’। আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও ‘র’ ও ‘ব’ এর বেড়াজালে আটকে দেয়া হয় ওই হাজতিকে। গেটের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দিলেই ‘ব’ আবার ‘র’ হয়ে যায়। কেউ টাকা দিতে না পারলে জামিন আদেশের পরেও তাকে কমপক্ষে একদিন অতিরিক্ত জেলহাজতে থাকতে হয়। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এসব কথা জানিয়েছেন হয়রানির শিকার কয়েকজন হাজতি।
তারা (হাজতি) আরো জানায়, আমদানিতে একদিন রাখার পর হাজতিদের অপরাধ অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানেও টাকা। অনেক অপরাধী এক জায়গায় বসবাস করায় প্রায়ই হাজতিদের মধ্যে মারামারি বাধে। মারামারি করার অপরাধে তাদের কেস টেবিলে (কারাগারের বিশেষ বিচারব্যবস্থা) হাজির করা হয়। তবে কারাগারের কিছু অসাধু সুবেদার, জমাদার ও সিআইডিদের টাকা দিলে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী। এর পরিপ্রেক্ষিতে উল্টো শাস্তি পেতে হয় নিরাপরাধীকে। ফলে কারাগারে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। সূত্রে আরো জানা গেছে, একটু ভালোভাবে গোসল করার জন্যও টাকা গুনতে হয় বন্দীদের। প্রতিবার গোসল করার জন্য যারা ৫০ থেকে ৬০ টাকা দিতে পারছেন শুধু তারাই পাম্পে বা বিভিন্ন সেলের সামনে গোসল করার সুযোগ পাচ্ছেন।
কারাগারের অভ্যন্তরে নগদ টাকা বহন করা বড় ধরনের অপরাধ। তাই বাইরে থেকে কেউ টাকা দিতে চাইলে ব্যাংক হিসাবের মতো পিসি বইতে টাকা জমা হয়। কারো টাকার প্রয়োজন হলে পিসি বইয়ের মাধ্যমে ক্যান্টিন থেকে লেনদেন করা হয়ে থাকে। আর এখানেই হলো আসল দুর্নীতি। কেউ ১০০ টাকা চাইলে তাকে দেয়া হয় ৯০ টাকা। বাকি ১০ টাকা কমিশন বাবদ কেটে রাখা হয়। যদিও টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে জেলার বলেছেন, এ ১০ টাকা পিসি বই তৈরি করার জন্য নেয়া হয়। এমন নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার পিসি বই তৈরি করার জন্য কোনো টাকা বরাদ্দ না দেয়ায় তারা এই টাকাটা নিয়ে থাকেন।
বন্দীদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা স্বজনেরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন দেখা করার ঘরে। তবে টাকা থাকলে সেখানেও রয়েছে স্বস্তি। হাজতি বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসা আব্দুর রহমান জানান, ‘আমার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলে সেখানে সিরিয়ালের অজুহাতে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে থেকেও দেখা করতে পারিনি। যখন এক কারা সদস্যকে তিন শ’ টাকা দিলাম সে সাথে সাথেই দেখা করিয়ে দিলো।’ তিনি আরো বলেন, এমন দৃশ্য যে কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই প্রতিনিয়ত দেখতে পারবেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এ টাকাটা সংগ্রহ করেন জনৈক কারারক্ষী। সরেজমিনে দেখা গেছে, স্পেশালভাবে কারাগারে থাকা স্বজনের সাথে দেখা করার জন্য কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে গেলেই ওই কারারক্ষীর হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিলেই ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় দেখা করার জন্য।
সূত্র মতে, কারাগারের সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে মেডিক্যালে। কারাবিধি অনুযায়ী যে রোগী আগে যাবে সে মেডিক্যালে সিট পাবে কিন্তু সেখানে চলে এর উল্টো। টাকার বিনিময়ে সুস্থদের সিট পাইয়ে দেয়া হয়। আর প্রকৃত অসুস্থরা থাকে মেঝেতে। তবে কারা পরিদর্শকদল পরিদর্শনে গেলে অসুস্থদের বেডে রাখা হয় কিন্তু তারা চলে গেলে আগের নিয়ম চালু হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মেডিক্যালে ১৫ দিন থাকার জন্য ১৫ শ’ টাকা এবং এক মাস থাকার জন্য ২৫ শ’ টাকা দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হাজতি জানিয়েছে, যে কেউ দিব্যি সুস্থ হয়েও অসুস্থতার সার্টিফিকেট নিয়ে শেবাচিম হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়। সেখানে বসে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে খোলামেলা আলোচনা, খাওয়া-দাওয়া ও মোবাইল ফোনে কথা বলার অপার সুযোগ পাচ্ছে। কিছু কারা চিকিৎসকের সাথে আঁতাত করে সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেয় দালালেরা। ওই সার্টিফিকেটের জন্য প্রতিজন বন্দীকে দিতে হয় এক থেকে দুই হাজার টাকা।
সূত্র মতে, কারাগারের অভ্যন্তরে অবাধেই মিলছে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। কারাগারে বিক্রি হওয়া মাদকের বাইরেও রয়েছে ঘুমের ট্যাবলেটের ব্যবস্থা। কারাভ্যন্তরে কিছু কারারক্ষী এসব মাদকদ্রব্য সরবরাহ করছেন বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। তবে কারাগার থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে ইতঃপূর্বে বেশ কয়েকবার। বিশেষ করে কিছু সিআইডি ও মেডিক্যাল চিফ রাইটারের মাধ্যমে মাদক সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। কারণ সিআইডি সদস্যদের গেটে তল্লাশি করা হয় না। তাই কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই কারাভ্যন্তরে মাদক প্রবেশ করান কিছু অসাধু সদস্য। তবে মাদকের বিষয়টি জেলার সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
সূত্র মতে, কারাগারের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত মোবাইলও অবৈধভাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। কারাগারে এই মোবাইলের সাঙ্কেতিক নাম ‘ময়না পাখি’। মোবাইলের মালিক নিজেও ব্যবহার করেন এবং ভাড়াও দেন। ফলে ভেতরের সব খবরা-খবর এক নিমেষেই বাইরে চলে যায়। অভিযোগ রয়েছে, যে সব সন্ত্রাসী কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে, তারা বাইরের অপরাধ জগতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে মোবাইলের মাধ্যমে। যার ফলে যেকোনো অপরাধকর্মকা সহ মাদক ব্যবসা নির্বিঘেœ পরিচালনা করতে সক্ষম হয় কারাগারে বসেই।
জানা গেছে, কারাগারের সব দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে খোঁজখবর রাখার জন্য ডিআইজি প্রিজনের পক্ষ থেকে একজন সিআইডি সদস্য রয়েছেন বরিশাল কারাগারে। তবে ডিআইজির কাছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের বড় বড় দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা গোপন রাখা হয়। ফলে কারা কর্তৃপক্ষের সাথে আঁতাত করে এখান থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছেন দায়িত্বরত কিছু অসাধু কর্মকর্তা। যে সব কয়েদি কারা কর্তৃপক্ষের সাথে তাল মিলিয়ে থাকে তারাই রাজত্ব করে পুরো কারাগারে। আর যারা কারা কর্তৃপক্ষের মন জোগাতে ব্যর্থ হয়, তাদের সইতে হয় নির্যাতন। আর তাদের কাজ করতে হয় ফুলের বাগান, সুইপার চালি, তাঁত চালি বা রান্না ঘরে।
একাধিক বন্দী জানায়, খাবারের তালিকায় মাছের যে সাইজ উল্লেখ থাকে তা কখনোই দেয়া হয় না। তালিকায় ইলিশ, রুই, কাতলসহ বিভিন্ন মাছ খাওয়ানোর কথা থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই দেয়া হয় পুকুরে চাষ করা পাঙ্গাশ মাছ। আর যে গোশত খাওয়ানো হয় তাও পরিমাণে খুব কম। তবে টাকার বিনিময়ে ক্যান্টিন থেকে চড়া মূল্যে মাছ ও গোশত কিনে খেতে পারে বন্দীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নামের ভুলসংশোধনী, আমদানি, ওয়ার্ড, গোসল, খাবার, ক্যান্টিন, হাজতিদের টাকার কমিশন, দেখার ঘর, মেডিক্যালÑ সব মিলিয়ে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা উপার্জন হয় অবৈধভাবে। অভিযোগ রয়েছেÑ জেলার, ডেপুটি জেলার থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক, সুবেদার, কারারক্ষীরা এ টাকার ভাগ পাচ্ছেন। বর্তমানে জেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো: নুরুজ্জামান। তাই তিনি বেশি খোঁজখবর না নেয়ায় কারাগারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি জেঁকে বসেছে।
কারাগারের ভেতর ও বাইরের সব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে জেলার মো: ইউনুস জামান বলেন, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে যে জনবল রয়েছে তা ৬৩৩ বন্দীর জন্য। কিন্তু কারাগারে প্রায় দ্বিগুণ বন্দী রয়েছে। তাই এখানকার নিরাপত্তা জোরদার করতে আরো কারারক্ষী প্রয়োজন। এ বিষয়ে জানতে জেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো: নুরুজ্জামানের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তা রিসিভ না করায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কারা ডিআইজি (প্রিজন) মো: ছগির মিয়া বলেন, কারাগারে যদি কোনো দুর্নীতি হয় তাহলে সব অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, ১৮২৯ সালে ২০.৩ একর জমির ওপর বরিশালে কারাগার নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই এটিকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে জেলা কারাগার থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করা হলেও সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি একাংশও। মাত্র ৬৩৩ জন ধারণ ক্ষমতার বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে বন্দী রয়েছে ১২৬০ জন। এদের মধ্যে ফাঁসির আসামি ৭২ জন। যার মধ্যে দুইজন নারী। সিনিয়র জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলার ও চিকিৎসকসহ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে মোট ৩৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এখানে পুরুষ কারারক্ষীর সংখ্যা ২৫১ জন। এর মধ্যে পদ শূন্য রয়েছে ১১টি। মহিলা কারারক্ষী হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন ১১ জন। এ ছাড়া এখানে চারটি ডেপুটি জেলারের পদ থাকলেও দুইটিই শূন্য।

 


আরো সংবাদ



premium cement