চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে বাইপাস ও ফ্লাইওভার প্রকল্প আলোর পথে
প্রকল্প ব্যয় ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা- এস এম রহমান পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)
- ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দুই দেশের যৌথ অর্থায়নে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৬ লেনের চারটি বাইপাস ও একটি ফ্লাইওভার স্থাপন প্রকল্প অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে আট হাজার ৫৫৬ কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সহায়তা রয়েছে (জাইকার) পাঁচ হাজার ৭০৯ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ও বাংলাদেশ সরকারের দুই হাজার ৮৪৭ কোটি চার লাখ ৭২ হাজার টাকা। যৌথ অর্থায়নে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত প্রকল্পটি অবশেষে আলোর মুখ দেখছে বলে প্রত্যাশা করছেন পিডি প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১২৬ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ২৫.২৭ কিলোমিটার অংশে ৪টি বাইপাস ও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি স্থানের মধ্যে পটিয়া, দোহাজারী. চকোরিয়া ও আমিরাবাদে হচ্ছে একটি করে বাইপাস আর সাতকানিয়ার কেরানীহাট অংশে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ফ্লাইওভার। ৬ লেনের বাইপাসগুলোর দৈর্ঘ্য হচ্ছে পটিয়া বাইপাস ৫.৭২ কিলোমিটার, দোহাজারী বাইপাস ৩.৫১ কিলোমিটার, লোহাগাড়া বাইপাস ৪.২৫ কিলোমিটার, চকোরিয়া বাইপাস হচ্ছে ৭.৪৭ কিলোমিটারের, অপর দিকে ৬ লেনের কেরানীহাটের ফ্লাইওভারটি ৩.৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে।
গৃহীত প্রকল্পে বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ (এশিয়ান কানেন্টিভিটি জোরদারকরণ), ভারত মিয়ানমার ও চীনের সাথে সরাসরি আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এর আগে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটি পাবলিক-পার্টনারশিপের মাধ্যমে ৬ লেনে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞদলের মাধ্যমে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। বুয়েটের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাদিউজ্জামানের নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা, অভয়ারণ্য, জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিবেশের ওপরে বেশি গুরুত্বারোপ করে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এশিয়ান কানেক্টিভিটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিবেশ জীববৈচিত্র্য অভয়ারণ্য ও প্রাণিকুলের অবাধ বিচরণ যাতে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি বিবেচনায় এনে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, সোনাদিয়া ট্যুরিজম পার্ক, সারবরাং ট্যুরিজম পার্ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, মাতারবাড়ী বন্দর, মাতারবাড়ী ও বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, পদ্মা ব্রিজ, পায়রা পোর্ট, মহেশখালী পোর্ট, মিরসরাই ইকোনমিক জোনসহ আরো অনেক ইকোনমিক জোনের কারণে দ্রুত দেশী-বিদেশীদের বিনিয়োগ বাড়ছে। সেই সাথে দ্রুতগতিতে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা, সে কারণে যোগাযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়ে যাবে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা। মাতারবাড়ী থেকে কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম, আবার চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ী কক্সবাজার যাওয়া আসার ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত ট্রাফিক ভলিউম হবে তা নিয়ন্ত্রণে অনেক বড় একটি ভূমিকা রাখবে মহাসড়কটি। সে কারণে এই মহাসড়কের কক্সবাজার পয়েন্ট থেকে পটিয়া ক্রসিং পর্যন্ত মহাসড়ককে অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করার ওপরে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে। সরকারের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অংশ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নীত করে গড়ে তোলা। সমীক্ষায় ওই বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাদিউজ্জামান ওই সময়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছিলেন মহাসড়ক উন্নীতকরণকল্পে ভাবা হয়েছে এর ব্যয়ভার নিয়েও। পরিবেশ জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা করে এই মহাসড়ককে দুইভাবে বাস্তবায়নের জন্য চিন্তা করা হয়েছে। সে কারণে দুইভাবে মহাসড়কের সমীক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উপরোক্ত বিষয়াদি ছাড়াও জমি অধিগ্রহণ ও সেই জমিকে মহাসড়কে রূপান্তর করার বিষয়টির সক্ষমতাও ভাবা হয়েছে। এসব চিন্তাভাবনা করে এই মহাড়ককে চারলেন ও ছয়লেন (এক্সপ্রেসওয়ে) করে একই সাথে দু’টি সমীক্ষা প্রস্তুত করা হয়েছিল। সমীক্ষায় মহাসড়কের সম্পূর্ণ অংশ উড়াল সড়ক করার কথা বলা হয়েছিল, আবার কিছু অংশ উড়াল ও কিছু অংশ এলিভেটেড করার সুপারিশ করা হয়েছিল ওই সমীক্ষায়। সমীক্ষার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই মহাসড়কের ইন্টারচেঞ্জ স্থাপন করার (সড়কের সাথে সড়কের সংযোগ বা বিনিময়) কথা ছিল প্রকল্পে। এছাড়া প্রকল্পের একাধিক স্থানে বেশ কিছু বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। অপরদিকে জাইকার অর্থায়নে মহাড়কের উন্নয়নকল্পে ইতোমধ্যে মহাসড়কের পটিয়া চানখালী খাল, কক্সবাজারের মাতামুহুরি নদী, চন্দনাইশের শঙ্খ ও বরুমতি খালের ওপর ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি অত্যাধুনিক পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হাদিউজ্জামান ওই সময় নয়া দিগন্তকে জানিয়েছিলেন মহাসড়ক উন্নীতকরণে চারলেন ও ছয়লেন উপযোগী করে দু’টি সমীক্ষা করা হয়েছে। একই সড়ক নিয়ে দু’টি সমীক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশ এগিয়ে চলছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। তাছাড়া এই মহাসড়ক এশিয়ান কানেক্টেভিটির অন্যতম স্থলপথের যোগাযোগব্যবস্থা হয়ে উঠবে। সে কারণে দুইভাবে সমীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এখন থেকে ২০৪০ বা ২০৫০ সাল পর্যন্ত চারলেন সড়ক হয়তো সমীচীন হবে কিন্তু তারপরে যে দেশী-বিদেশী যানবাহনের চাপ বাড়বে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সে কারণে ৬ লেন উপযোগী করার জন্যও সমীক্ষায় বলার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
জানা গেছে, এডিবির অর্থায়নে সর্বপ্রথম ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সুইডিস কনসালট্যান্ট (ঐওঋঅই) নামে একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ কাজের সর্বপ্রথম সার্ভে সমাপ্ত করা হয়েছিল। এরপরই ২০১৭ সালের ৬ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠানে মহাসড়কটিকে বর্তমান সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে উন্নীতকরণের ঘোষণা দেন। চারটি বাইপাস ও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বাকি অংশ ১০০ কিলোমিটারের কম সড়কটি দুই পাশে ২.৫০ মিটার সার্ভিস লেইনসহ ৪ লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে ওই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য জানান, গত বছরের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তা সম্পন্ন হলেই নতুনভাবে ডিজাইন করে অচিরেই এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে।