১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাওয়া সিনেমায় বন্দী শালিক নিয়ে পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ

হাওয়া চলচ্চিত্রের কয়েকটি দৃশ্যে খাঁচায় বন্দী একটি শালিক পাখি দেখানো হয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন পরিবেশবাদীরা। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে সদ্য মুক্তি পাওয়া একটি বাংলা চলচ্চিত্রে বন্যপ্রাণী শালিক পাখি খাঁচায় আটক দেখানো ও তাকে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য থাকায় উদ্বেগ জানিয়েছে পরিবেশবাদী ৩৩টি সংগঠন।

চলচ্চিত্রের ওই দৃশ্যটি সংশোধন করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তারা পরিচালক ও অভিনয় শিল্পীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর একটি জোট, বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট দাবি করছে, চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকটি দৃশ্য রয়েছে যা বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত এ ধরনের অপরাধের ফলে সাধারণ মানুষ পাখি শিকার, খাঁচায় পোষা ও হত্যা করে খাওয়ায় উৎসাহিত হবে।

এটি ছাড়াও সম্প্রতি আরো কয়েকটি নাটক ও বিজ্ঞাপন চিত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন করতে দেখা গেছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জোট। এর ফলে বন্যপ্রাণীর জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে তারা মনে করে।

তবে ছায়াছবিটির পরিচালক বলছেন, ফিকশন হিসেবে ওই দৃশ্য দেখানো হলেও কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা করা হয়নি।

গত মাসের ২৯ তারিখে মুক্তি পাওয়া 'হাওয়া' চলচ্চিত্রে ট্রলারে থাকা একটি খাঁচায় শালিক পাখি বন্দী অবস্থায় দেখা যায়। একপর্যায়ে সেটিকে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে।

ইউটিউবে প্রকাশ করা চলচ্চিত্রের 'বিহাইন্ড দ্যা সিনে' সামুদ্রিক প্রাণী শাপলা পাতা মাছ দেখানো হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, এরকম দৃশ্য এ ধরনের প্রাণী শিকারে উৎসাহিত করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের আহ্বায়ক ড.আহমদ কামরুজ্জামান বলছেন, ‘আমাদের আইনে বলা আছে, বন্যপ্রাণী বহন, আটকে রাখা, প্রদর্শন করা আইনের পরিপন্থী। আমরা যতদূর জানি, এই দৃশ্য ধারণের জন্য বনবিভাগের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। সেখানে যখন দেখানো হয় যে একটি বন্যপ্রাণীকে হত্যা করাা হয়েছে, খাওয়া হয়েছে, তখন অন্য মানুষ মনে করতে পারেন যে, এটা করা যায়। এই চলচ্চিত্রটি হাজার হাজার মানুষ দেখেছেন।’

তিনি বলেন, তারা এগুলো দেখে উৎসাহিত হতে পারেন, তাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা যাবে, এ জাতীয় কাজ করা যায়। ধুমপানের দৃশ্যে যেমন লেখা থাকে যে, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সিনেমার ওই অংশে এ ধরনের কোনো বার্তা ছিল না।

তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি করছি, চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন বন্ধ করে আইন লঙ্ঘনের চিত্র সংস্কার করতে হবে। সেইসাথে বন্যপ্রাণী হত্যার দৃশ্য দেখানোর জন্য পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট অভিনেতাকে ক্ষমা চাইতে হবে।’

একটি চলচ্চিত্রে এ ধরনের দৃশ্য দেখানোর পরেও বন বিভাগ কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নীরব থাকায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ড. কামরুজ্জামান অভিযোগ করেন, সম্প্রতি বেশ কিছু নাটক ও বিজ্ঞাপন চিত্রে বন্যপ্রাণী আটকে রাখার মতো দৃশ্য দেখানো হয়েছে। যা সবার মধ্যে বন্যপ্রাণী বিষয়ে একটি ভুল ধারণা তৈরি করছে।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২- সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার ফলে এ জাতীয় ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর ওই অভিযোগের বিষয়ে হাওয়া ছায়াছবিটির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি।

তিনি দাবি করছেন, চলচ্চিত্রে একটি নেতিবাচক চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য চলচ্চিত্রে খাঁচায় আটকানো শালিক পাখি এবং সেটিকে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু খাওয়ার দৃশ্যটি আসল নয়। বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রে ফিকশন করতে গিয়ে বন্যপ্রাণী দেখানো হয়, সেগুলোকে হত্যা করার মতো দৃশ্য থাকে। তাই বলে সত্যি সত্যি তো প্রাণী হত্যা করা হয় না। এটা তো একটা চলচ্চিত্র, কোনো ডকুমেন্টারি নয়। সেখানে একজন জেলে কীভাবে জীবনযাপন করে, তারই অংশ হিসেবে ওই পাখি দেখানো হয়।

পাখি হত্যা করে খাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরকম কোনো কিছুর তো প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে আসলে মুরগি খাওয়ানো হয়েছে। এখানে পজিটিভভাবে চরিত্রটা দেখানো হয়নি। একটি নেতিবাচক চরিত্রের, খারাপ মানুষের দৃশ্যায়নের অংশ হিসেবে পুরো ঘটনাটি দেখানো হয়েছে। ফলে সেটা দেখে কেউ এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণী আটকে রেখে প্রদর্শন করা হয় চিড়িয়াখানায়। তাহলে সেগুলো মুক্তির জন্য কেন তারা দাবি তুলছেন না?’

বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আটকে রাখা, হত্যা করার মতো অপরাধ দমনে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট নামে একটি বিভাগ রয়েছে।

ওই বিভাগের কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলছেন, হাওয়া সিনেমায় বন্যপ্রাণী খাঁচায় আটকে রাখা বা হত্যার দৃশ্য দেখানোর বিষয়ে তারা জানতে পেরেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন চলচ্চিত্রটি দেখবো। সেজন্য ইন্সপেক্টরদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে কীভাবে কি করা হয়েছে, সেটা দেখে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো।’

আইন অনুযায়ী, শালিক একটি সংরক্ষিত প্রাণী। এ জাতীয় পাখি বা প্রাণী খাঁচায় আটকে শুটিং বা প্রদর্শন করতে হলে বন বিভাগের অগ্রিম অনুমতি থাকতে হয়।

তিনি জানান, বন্যপ্রাণী আইনের লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে বন বিভাগ আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বা সাজা চেয়ে মামলা করতে পারে।

একটি নাটকে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি দেখানোর ৪৫ সেকেন্ডের দৃশ্য থাকায় পরিচালকের বিরুদ্ধে গত এপ্রিল মাসে ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছে ওই ইউনিট। ওই মামলাটি এখন বিচারাধীন রয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশে একটি বড় মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন চিত্রে খাঁচা বন্দী টিয়া পাখি দেখানোয় গত বছরের জুলাই মাসে মামলা করেছিল বন বিভাগ। এরপর ওই কোম্পানি বিজ্ঞাপন চিত্রটি সরিয়ে নেয়।

পাখি ধরার খাঁচা বিক্রির অভিযোগে বড় একটি অনলাইন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছিল।

সরাসরি বন্যপ্রাণী আটকে রাখা বা উদ্ধার হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা বা কারাদণ্ড দেয়ার উদাহরণ রয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement