২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘সমাজের মানুষগুলো উদ্ভট বিকৃত রুচির’

এ্যানী খান - ছবি : নয়া দিগন্ত

‘আমাদের সমাজের মানুষগুলো উদ্ভট বিকৃত রুচির। মানুষ অনেক নেস্টি (কুরুচিপূর্ণ)। তাদের চিন্তা-চেতনা নেস্টি। তবে ভালো মানুষও আছেন। তাদের সংখ্যা কম। জানেনই তো বাঙালি ভালো কাজে খুব বেশি থাকে না।’ বলছিলেন এক সময়ের ছোট পর্দার তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী উম্মে হাবিবা এ্যানী খান।

২০২০ সালের মার্চে অভিনয় জগত ছেড়েছেন তিনি। ২৩ বছরের ক্যারিয়ার ছেড়ে ধর্মীয় অনুশীলনে মনোনিবেশ করেছেন এ্যানী। কেন বিনোদন জগতের ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার ছাড়লেন এই অভিনেত্রী? ধর্মীয় অনুশীলনেই বা তাকে কে বা কোন জিনিসটি উৎসাহিত করেছে? দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে কি তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন? তাহলে টার্নিং পয়েন্ট কিভাবে উত্তরণ করেছিলেন তিনি? এখন কেমন আছেন প্রিয় এই অভিনেত্রী ও টিভি উপস্থাপিকা? অনন্ত জলিলদের মতো আবারো কি রঙিন জগতে দেখা মিলবে এ্যানীর? এমন অসংখ্য প্রশ্ন এ্যানীভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষিসহ কৌতূহলী বিনোদনপ্রেমীদের।

আপনাদের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে কথা হয়েছে এ্যানী খানের সাথে। সাক্ষাৎকারটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-

অভিনয় ছেড়ে ধর্মীয় অনুশীলন ও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে এ্যানী খান বলেন, ২০২০ সালের মার্চে আমি অভিনয় ছেড়েছি। গত বছর কাজ ছাড়ার পর ৯ মাস বাকি ছিল। নয় মাস আমি পুরোটাই প্রাকটিস (ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগি) করলাম। পরে রিয়ালাইজ করলাম, সব সময় যেহেতু ব্যস্ত থেকেছি (অভিনয়ে)। হঠাৎ করেই তো প্রাকটিস করছি, আসলে আমরা তো এখনো ওই লেভেলের মুমিন হতে পারিনি। আর সারাক্ষণই শুধু প্রাকটিসের ওপর থাকব, পড়াশুনা করব, এজন্য আরো তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ভয় ও প্রেম) প্রয়োজন। আর এমনিতেই যেহেতু আগের সার্কেল পরিবর্তন হয়ে গেছে। করোনাকাল এখন। আমরা চাইলেই এখানে সেখানে হুট-হাট করে যেতে পারি না।

আপনি যেমন হবেন তেমন সঙ্গের প্রয়োজন

তিনি বলেন, যেকোনো কিছুর জন্য মানুষের সঙ্গটা অনেক বেশি প্রয়োজন। আপনি যখন যেরকম হবেন তখন ওইরকম একটি সঙ্গের প্রয়োজন। এই চেঞ্জ হওয়ার পর যে আমাকে ডিপ্রেশনে (মানসিক যন্ত্রণা) ধরেনি তা কিন্তু নয়। তখন দেখা যায় যে শয়তানের ডিউটি বেড়ে যায়, ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য।

আরো পড়ুন

‘কুমিরের খাঁচায় গিয়ে বলব আমাকে স্পর্শ করো না, তা হয় না’

২০২১-এর মাঝে এসে আবারো সিদ্ধান্ত নিলাম যে ওকে ফাইন। আমি তাহলে কেন বসে আছি? ২০২০ সালেই আমি কয়েক দফা আমার ফেসবুকে ট্রাই করেছিলাম, কাপড় নিয়ে আমি ব্যবসা করবো। কিন্তু কিছু খারাপ মানুষ বলেন আর কিছু দুষ্টু মানুষ বলেন, তারা হচ্ছে বেকার মানুষ। যারা কিনা মানুষকে সব সময় নেগেটিভভাবে নেগেটিভ অ্যাডভাইস দেন। তাদের কথাটা ঠিক এমন ছিল যে এ্যানী অভিনয় ছেড়ে এখন ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার ব্যাপারটি দর্শকদের যারা জানার তারা ঠিকই জানেন।

‘পিক আওয়ারে কাজ ছেড়েছি’
নয়া দিগন্তের সাথে সাক্ষাৎকারে এ্যানী বলেন, প্রত্যেক আর্টিস্টের (শিল্পী) একটি পিক আওয়ার (গুরুত্বপূর্ণ সময়) থাকে। আমি একদম শিশুকাল থেকে কাজ করেছি। আমার যখন পিক আওয়ার ছিল, যখন আমার পাঁচটি-ছয়টি ধারাবাহিক নাটক টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল, আমি ১০টি সিরিয়ালে কাজ করছি, ওই মুহূর্তে কিন্তু আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি। যেটি রেয়ার কেইস (বিরল ঘটনা)। আমাদের এখানে এমনটি সাধারণত হয় না।
তার মতে, হয়তো বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে হয়ে গেছে এ কারণে ছেড়েছে। কিন্তু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে এভাবে হয়তো কম মানুষই ছেড়েছে।

যে কারণে অভিনয় ছেড়েছেন এ্যানী
তিনি বলেন, আমি যেটি করেছি তা কাউকে বলা বা দেখানোর জন্য নয়। আমি আমার নিজের জন্য, আমার মনের সন্তুষ্টির জন্যই কাজ (অভিনয়) ছেড়েছি।

এ্যানী বলেন, ব্যাপারটি কিন্তু এমন ছিল না যে আমার কাজ ছিল না, তাই ছেড়ে দিয়েছি। ‘টিল নাউ’ আমি কাজে ব্যাক করলে আমার কাজের অভাব হবে না। কারণ আমি ওরকমটি নয় যে খালি কলসি বাজে বেশি। আমি কিন্তু ভালো অ্যাক্টিনের (অভিনয়ের) জন্যই কাজটি পেতাম। গ্রামের নাটক বলেন, কমেডি নাটক বলেন, সবক্ষেত্রে হাতে গোণা কয়েকজন অভিনেত্রীর মধ্যে ছিলাম আমি একজন।

নতুন ব্যবসা শুরু প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে সাবেক এই অভিনেত্রী বলেন, আমি নিজে যখন পর্দা করা শুরু করলাম, বোরকা পরা শুরু করলাম। ... যে দোকান থেকে আমি প্রথম বোরকা কিনেছিলাম নিজের জন্য, ওই দোকান থেকে ব্যবসার জন্য প্রথম বোরকা এনেছি। তিনি পুরোপুরি আমাকে বাকিতে পণ্য দেন। আমি ‘জিরো ইনভেস্টমেন্টে’ ব্যবসা শুরু করি। আমার কোনো বিনিয়োগ ছিল না। এটা করার পর আমি দেখলাম, আমার সাথে দুবাই থেকে মানুষ যোগাযোগ করছে, ওখান থেকে একজন যোগাযোগ করলেন। তিনি একজন বাঙালি, ওখানে বোরকার দোকানে কাজ করেন। তিনি আমার মুখের কথায় দেড় লাখ টাকার প্রোডাক্ট বানিয়ে ফেললেন। আমি তাকে শুধু পাঁচ হাজার টাকার টোকেন মানি দিয়েছি। এটি আল্লাহরই সাহায্য। না হয় আমি এসব কোথা থেকে পাবো!

ব্যবসার ক্ষেত্রে যাদের সহযোগিতা পেয়েছেন এ্যানী
তার ভাষায়, যারা ধর্মপ্রাণ মানুষ আছেন, সৌদি আরব, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর- এই সব জায়গা থেকে যারা প্রবাসী আছেন, যারা আমার নাটক বেশি করে দেখতেন, কিন্তু এখন দেখেন না। আমি চেঞ্জ হয়ে গেছি। তারা আমাকে বিপুলভাবে সমর্থন দিয়েছেন। তারা আমাকে বিশ্বাস করেন। আমার কিন্তু ‘ক্যাশ হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ নেই। পুরোটাই অ্যাডভান্স পেমেন্ট করতে হয়। পরে প্রোডাক্ট পৌঁছে দেই। মানুষ এ যুগে কেউ কাউকে এক টাকার বিশ্বাস করে না। তারা কিন্তু আমাকে ফুল টাকাটাই অ্যাডভান্স দেয়।

এ্যানী বলেন, আমি যে খুব বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছি তা কিন্তু নয়। আমি ব্যস্ততার মাঝে আছি। ধর্মীয় বিষয়গুলো পালন করছি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছি। ঘরে থেকে প্রোডাক্টগুলো ডেলিভারি দিতে পারছি। এখন আমি ঘরে বসেই ব্যবসাটা করছি।

জীবনে বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না
উম্মে হাবিবা এ্যানী বলেন, একজন মানুষ চলতে গেলে কি খুব বেশি টাকার প্রয়োজন? বেশি টাকার প্রয়োজন না। প্রয়োজনটা আমরা বানাই। আমাদের জীবনযাপনকে অনেক বেশি বিলাসবহুল করে ফেলি। কিন্তু আমি যখন মিডিয়াতে কাজ করতাম, তখন বিলাসী ছিলাম না, এখনো বিলাসবহুল না।

ফেসবুকে বোরকা-স্যালোয়ার কামিজ বিক্রি, ইউটিউবে হাদিসের আলোচনা
নিজের ফেসবুক ভেরিফায়েড পেইজকে ব্যবহার করে বোরকা, হিজাব ও স্যালোয়ার কামিজ বা থ্রি-পিস বিক্রির ব্যবসা করছেন এক সময়ের তারকা অভিনেত্রী এ্যানী খান। একইসাথে নিজের ধর্মীয় অনুশীলন ও জ্ঞানচর্চাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করছেন একটি ইউটিউব চ্যানেলে। এ্যানী খানের ওই চ্যানেলে এরই মধ্যে ২০ হাজারের সাবস্ক্রাইব হয়েছে।

এ্যানী বলেন, আমার ওই ইউটিউব চ্যানেল থেকে যতটুকুই আয় হবে তা দ্বীনের কাজে ব্যয় করবো। তবে খুব বেশি আয় হবে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ ব্যাখ্যায় সাবেক এই অভিনয় শিল্পী বলেন, এটা ভালো কাজ। আর ভালো কাজের সাথে বাঙালি খুব একটা থাকে না। যেখানে আমার মিলিয়ন বিলিয়ন ভিউয়ারস ছিল সেখানে এখন ধীর গতিতে যাচ্ছে। কারণ সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা কম। ...যাই হোক, ওখান থেকে যেটুকুই আমি আয় করবো পুরোটাই দ্বীনের রাস্তায় দিয়ে দিব, ইনশাআল্লাহ।

আরো পড়ুন

‘কুমিরের খাঁচায় গিয়ে বলব আমাকে স্পর্শ করো না, তা হয় না’

চলমান ব্যবসা প্রসঙ্গে এ্যানী বলেন, ওখানেই হালাম-হারাম খুঁজে। দুবাই থেকে প্রোডাক্ট এনে ব্যবসা করছি। ওখানেও মানুষ কেন যেন ওঁত পেতে বসেই থাকে আমি কী ভুল করবো। আমার কোন ভুলটি ধরা যায়। এভাবেই চলছে। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রটি পজিটিভ ওয়েতে যায়। কাজ ছাড়ার পর বুঝতে পেরেছি মানুষ আমাকে অনেক ভালোবাসে। তারপরও কিছু কীট তো থাকবেই। নর্দমার পোকা তো কিছু থাকেই। এটা ধরে তো লাভ নেই।

অনেকটা বিরক্তির সাথে সাবেক জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা ও অভিনেত্রী বলেন, ‘মানুষ অনেক নেস্টি (কুরুচিপূর্ণ)। তাদের চিন্তা চেতনা নেস্টি। আমাদের সমাজের মানুষগুলো উদ্ভট বিকৃত রুচির। ভালো কাজে তাদের খুব বেশি পাবেন না।’


আরো সংবাদ



premium cement