২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের গাওয়া লোকজ গানের কপিরাইট যেভাবে পেল সরলপুর ব্যান্ড

চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের গাওয়া লোকজ গানের কপিরাইট যেভাবে পেল সরলপুর ব্যান্ড - ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি অভিনেতা মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরীর গাওয়া একটি গান সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর সেটির কপিরাইট দাবি করে অভিযোগ তোলে সরলপুর নামে একটি ব্যান্ড, আর তারপর থেকেই ওই গানের কপিরাইট বা মেধা স্বত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

চঞ্চল চৌধুরী আর মেহের আফরোজের গাওয়া ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি সোশ্যাল মিডিয়ায় সাড়া ফেলার পর সরলপুর ব্যান্ড, গানটির কপিরাইট তাদের বলে দাবি করে অভিযোগ তোলে। সরলপুর ব্যান্ডের সদস্যরা তাদের ফেসবুক পেইজ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে অভিযোগ তোলে যে ২০শে অক্টোবর ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামে ‘আইপিডিসি আমাদের গান’ নামের ইউটিউব চ্যানেল প্রকাশিত গানটিকে ‘লোকজ সঙ্গীত ও সংগৃহীত গান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেই দাবিটি সত্য নয় বলছে সরলপুর ব্যান্ড, কারণ তারা গানটির স্বত্বাধিকারী।

পরিবেশক প্রতিষ্ঠান যেন সব ধরণের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে গানটি সরিয়ে নেন সেই আহ্বান জানানোর পাশাপাশি গানটি সরিয়ে না নেয়া হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্কও করেন তারা।

অভিযোগ ওঠার পর চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের গাওয়া গানটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলে গানটির পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ‘আইপিডিসি আমাদের গান’।

তবে গানটি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর অনেকেই এই গানটিকে প্রাচীন লোকগানের সংকলন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করেন এবং গানটির কপিরাইট আনুষ্ঠানিকভাবে সরলপুর ব্যান্ডের হওয়া উচিত না বলেও অভিযোগ তোলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।

কপিরাইট নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হল কেন?
যেই গানটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেই গানটির ভিডিও সরলপুর ব্যান্ড তাদের ইউটিউব পেইজে আপলোড করলেও গানটির কপিরাইট যে তাদেরই সেই বিষয়টি উল্লেখ করেনি বলে জানান বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী।

জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘কপিরাইটের সনদ নেয়ার পরও তারা ইউটিউবে তাদের ভিডিওতে এটি উল্লেখ করেনি, যেই দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’

‘আমরা যাচাই করে দেখেছি, ইউটিউবেই ওই একই গানের নয়-দশটি ভার্সন রয়েছে। কিন্তু তারা অন্য কারো বিরুদ্ধে গানটির কপিরাইট আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ তোলেননি। অনেক বেশি ভিউ হওয়া ভার্সনটির বিরুদ্ধেই তারা অভিযোগ তুলেছেন, গত বছরেও এই একই গানকে কেন্দ্র করে একই ধরণের অভিযোগ তুলেছিলেন তারা।’

কিন্তু এই গানটি যদি বহুবছর ধরে চলে আসা লোকগীতি হয় এবং ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কেন গানটির কপিরাইট সরলপুরকে প্রদান করলো?

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, কপিরাইট সনদ দেয়ার আগে কোনো গান মৌলিক কিনা, সেই বিষয়ে তদন্ত করার মত আইনি বা পদ্ধতিগত অবকাঠামো কপিরাইট অফিসের নেই

কীভাবে গানটির কপিরাইট পেলো সরলপুর ব্যান্ড?
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো গানের কপিরাইট করতে হলে একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করতে হয় বলে জানান কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী।

কপিরাইট করতে চাওয়া গানটি মৌলিক গান এবং সেটির কোনো অংশ কোনো জায়গা থেকে হুবহু কপি করা হয় নি - এরকম কিছু শর্ত সম্বলিত হলফনামায় গানের স্বত্বাধিকার দাবি করা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্বাক্ষর করতে হয়।

এরপর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এক মাসের মধ্যে ওই ব্যক্তিকে সেই গানের কপিরাইটের সনদ দেয়া হয়।

কিন্তু এই সনদ দেয়ার আগে গানটি মৌলিক কিনা, সেই বিষয়ে তদন্ত করার মত আইনি বা পদ্ধতিগত অবকাঠামো কপিরাইট অফিসের নেই বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কোনো গান, শিল্পকর্ম বা লেখার কপিরাইটের জন্য আবেদন করে, যুক্তিসঙ্গত ভাবেই আমরা সেটির বিষয়ে তদন্ত করি না। কারণ যে ব্যক্তি কোনো গান, শিল্পকর্ম বা লেখার কপিরাইট নেয়, তিনি নিশ্চয়ই সেটি কোথাও না কোথাও প্রকাশ করবেন। আর তার কপিরাইটের দাবি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে সেটি প্রকাশিত হওয়ার পর মূল স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে অভিযোগ আসবে বলেই আমরা ধরে নেই।’

‘যুবতী রাধে’ গানের কপিরাইটের আবেদন করার ক্ষেত্রে সরলপুর ব্যান্ড, গানের কথা ও সুরকে নিজেদের মৌলিক সৃষ্টি বলে দাবি করার কারণে গানটির কপিরাইটের সনদ তাদেরকে দেয়া হয়েছে বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী।

তিনি জানান, ‘তাদের ৪২ লাইনের গানের শেষ তিনটি লাইনের সাথে ময়মনসিংহ গীতিকা-র তিন লাইনের আংশিক মিল ছিল, তবে হুবহু মিল ছিল না।’

তবে বাংলাদেশের কপিরাইট আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে গানটির কপিরাইট সনদ নেয়া আইনিভাবে সিদ্ধ হলেও ব্যান্ডের জন্য ‘অনৈতিক পদক্ষেপ’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন চৌধুরী।

এই বিষয়টি আলোচনায় আসার পর গানটি সম্পর্কে আরো খোঁজ-খবর নিয়েছেন বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তারা কপিরাইট আবেদনে দাবি করেছিল যে গানটির কথা ও সুর তাদের তৈরি। কিন্তু পরে আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে গানের কথা হয়তো তাদের লেখা, তবে তারা যেই সুর ব্যবহার করেছে তা বাংলাদেশের একটি লোকজ গানের সুর - যেটি আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন অনুসারে টিসিই (ট্র্যাডিশনাল কালচারাল এক্সপ্রেশন বা ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি) এর আওতায় পড়ে।’

বাংলাদেশের বর্তমান আইনে ট্র্যাডিশনাল কালচারাল এক্সপ্রেশন সংরক্ষণের সেরকম সুযোগ নেই বলে জানান চৌধুরী। তবে ট্র্যাডিশনাল কালচারাল এক্সপ্রেশনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কপিরাইট আইনের সংশোধনের খসড়া কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে, যা অনুমোদিত হলে এই ধরণের ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে জানান তিনি।

‘লালনের গান থেকে কয়েকটা লাইন নিয়ে বা সুর কপি করে কেউ যদি কপিরাইট দাবি করে, তখন কিন্তু সবসময় আমাদের কিছু করার থাকে না। কিন্তু আইন বাস্তবায়িত হলে এরকম ক্ষেত্রে সরকার ওই গান বা কবিতাটি সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী হতে পারবে।’

বর্তমান আইনের অস্পষ্টতা
কপিরাইট আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন বাংলাদেশের বর্তমান আইনে মুখে মুখে চলে আসা লোকজ গান সংরক্ষণ করার মত কোনো আইনি অবকাঠামো নেই।

তিনি বলেন, ‘যেই গানটি নিয়ে বিতর্ক চলছে, সেটি বাদে আরো অনেক গান আছে যেগুলোর সুরটা বা কথাটা একটু পরিবর্তন করে কপিরাইট দাবি করা সম্ভব হয়। আইনে ফাঁক ফোকর থাকার কারণে এভাবে কপিরাইট দাবি করা সম্ভব হয়।’

‘আর বাংলাদেশের বর্তমান আইনে একটি গানের গীতিকারই, অর্থাৎ গানের কথা যিনি লেখেন, শুধুমাত্র কপিরাইটের স্বত্বাধিকার পেতে পারেন তিনি। আর গানের সুরকার সহযোগী হিসেবে থাকলেও গানের মূল মালিকানা গীতিকারের।’

তানজিম আল ইসলাম মনে করেন আইনে এই অস্পষ্টতা থাকার কারণেই সুপরিচিত লোকজ গান হওয়া স্বত্বেও সরলপুর ব্যান্ড বিতর্কের জন্ম দেয়া গানটির কপিরাইট পেয়েছে।

বহুবছর ধরে চলে আসা লোকজ গান গাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো শিল্পী কথা বা সুরে কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবেন, আদৌ করতে পারবেন কিনা - এই ধরণের বিষয় বাংলাদেশের কপিরাইট আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তানজিম আল ইসলাম।

‘যেমন অনেক লোকজ গানেরই কিন্তু রিমিক্স হচ্ছে, কিন্তু কোন গান কতটুকু রিমিক্স করা যাবে বা কতটুকু পরিবর্তন করা যাবে তার কোনো মাপকাঠি বা রূপরেখা আইনে উল্লেখ করা নেই।’

আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো গানের রচয়িতা মারা যাওয়ার ৬০ বছর পর পর্যন্ত তার উত্তরাধিকারীরা সেই গানের স্বত্ব ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু জনপ্রিয় লোকজ গানের, যেমন লালনের গানের ক্ষেত্রে কীভাবে সেগুলোর কপিরাইট সংরক্ষণ করা হবে, সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই বলে জানান তানজিম আল ইসলাম।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement