২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনার ছুবলে এবার ‘অদৃশ্য’ কান

করোনার ছুবলে এবার ‘অদৃশ্য’ কান - ছবি : সংগৃহীত

একটি উৎসবের জন্য সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র প্রেমিরা বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন, নির্মাতা ও শিল্পীরা পরিশ্রমের সেরা স্বীকৃতিটা চান এখান থেকে। অথচ সেই কান চলচ্চিত্র উৎসব এবার ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছে করোনার ছুবলে। উৎসবের ৭৩তম রঙিন ক্যানভাস ঢেকে গেছে করোনাভাইরাসের কালো মেঘে।

বিশ্বব্যাপী এই মহামারীর কারণে এবারের উৎসবটি চেনা রূপে হচ্ছে না। গত ১২ মে শুরু হয়ে ২৩ মে পর্যন্ত এই আয়োজনের জৌলুস দেখা যাওয়ার কথা ছিল।

গত ১৯ মার্চ কানের ৭৩তম আসর জুলাই পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। ১৫ এপ্রিল উৎসবের নতুন সময়সূচি চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা ছিল আয়োজকদের। কিন্তু এর দুই দিন আগে ফ্রান্স সরকার জানিয়ে দেয়, এবারের গ্রীষ্মে কোনো বড় আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। সেপ্টেম্বরে সাধারণত ভেনিস ও টরন্টো উৎসব হয়ে থাকে। সুতরাং ওই সময়ে করার প্রশ্নই আসে না। অক্টোবর কিংবা নভেম্বরেও উৎসবটি করা সম্ভব নয়।

তবে আয়োজকরা উৎসবটি কোনোভাবেই বাতিল করতে চাননি! ইতিহাসে কেবল একবারই ১৯৩৯ সালে কান বাতিল হয়েছিল। এছাড়া ১৯৬৮ সালের আয়োজন ছাত্র আন্দোলনের কারণে পুরোপুরি শেষ হতে পারেনি। ২০২০ সালের উৎসব অদৃশ্য আসর হিসেবে ইতিহাসে পাতায় লেখা থাকবে।

‘অ্যামোনাইট’ ছবিতে কেট উইন্সলেট ও সার্শা রোনানউৎসবের আনুষ্ঠানিকতা না গড়ালেও অফিসিয়াল সিলেকশন ঠিকই ঘোষণা করেছে আয়োজকরা। বুধবার (৩ জুন) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় ফ্রান্সের প্যারিসে এক আয়োজনে ছবিগুলোর নাম জানানো হয়। এতে ‘অ্যামোনাইট’, ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ডিসপাচ’সহ আছে মোট ৫৬টি ছবি। পর্দা ও দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো কমেডি ধাঁচের ছবি রাখা হয়েছে তালিকায়।

কান উৎসবের জেনারেল ডেলিগেট থিয়েরি ফ্রেমো বলেন, ‘চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কঠোর পরিশ্রমের কথা ভেবে আমরা হাল ছাড়িনি। ২০২১ সাল পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষায় রাখতে চাইনি। তাই করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ছবি নির্বাচন প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়েছি। এটাই আমাদের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।’

প্যারিসে কান কর্তৃপক্ষের অফিসে প্রথমে সম্মিলিতভাবে ও পরে এককভাবে জমা পড়া ছবি দেখা হয়েছে। নির্বাচন কমিটি সদস্যরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছবি পেয়ে ঘরে বসে দেখেছেন। তারপরে লিখিত মতবিনিময় ও অনেকদিন কথোপকথনের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছবিগুলো আলাদা করা হয়। এর মধ্যে কিছু নির্মাতা নিজেদের ছবির মুক্তি ২০২১ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবারের কান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তারা আগামী আসরে আবারো ছবি জমা দেবেন।

এবার জমা পড়েছিল ১৪৭টি দেশের ২ হাজার ৬৭টি ছবি। এবারই প্রথম সংখ্যাটা দুই হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে ছিল ১৩৮টি দেশের ১ হাজার ৮৪৫টি ছবি। দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে জমা পড়ে ১ হাজার ৯১৬টি ও ২০১৭ সালে এসেছিল ১ হাজার ৮৮৫টি ছবি। ২০১০ সালে জমা পড়েছিল ১ হাজার ৬৬৫টি।

জমা পড়া ২ হাজার ৬৭টি ছবির মধ্যে ৯০৯টিই নির্মাতার প্রথম কাজ। অন্য যেকোনো আসরের চেয়ে সংখ্যাটা বেশি। এর মধ্যে ২৫৮টিই পরিচালনা করেছেন নারীরা, যা মোট জমাকৃত ছবির ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকি ৬৫১টির নির্মাতা পুরুষ (৭১ দশমিক ৬ শতাংশ)।

কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে সাধারণ ৬০টির মতো ছবি থাকে। গত বছর ছিল ৫৯টি। ২০১৮ সালের মতোই ৭৩তম আসরে জায়গা পেয়েছে ৫৬টি। এবার ১৫ জন নির্মাতার প্রথম ছবি জায়গা পেয়েছে, যা মোট নির্বাচিত ছবির ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১০ (১৭ শতাংশ)। এর আগে কখনও এত নবীন পরিচালক জায়গা পাননি কানে।

এবার ৫৩২ নারী পরিচালক ছবি জমা দিয়েছেন, যা মোট জমাকৃত চলচ্চিত্রের ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও ২০১৯ সালের চেয়ে সংখ্যাটা কম। গতবার জমা পড়েছিল ৫৭৫ জন নারী পরিচালকের ছবি।

তবে এবার অফিসিয়াল সিলেকশনে নারী নির্মাতার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬। গতবার তা ছিল ১৪। ২০১১ সালে ৮, ২০১৭ সালে ১২, ২০১৬ সালে ৯ ও ২০১৫ সালে ৬ জন নারী পরিচালকের ছবি জায়গা পেয়েছিল কানে।

প্রতিবার ১০-১৫টি ফরাসি ছবি থাকে কানে। এবার সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ২১। ২০১৭ সালের চেয়ে ৫টি, ২০১৮ সালের তুলনায় ১১টি ও ২০১৯ সালের চেয়ে ৮টি ফরাসি ছবি বেশি ৭৩তম কানে। নির্বাচিত ২১টির মধ্যে ৮টির নির্মাতা নারী, যা মোট সংখ্যার ৩৮ শতাংশ। ৯টি ছবিই নির্মাতার প্রথম কাজ, যা ৪২ শতাংশ।

‘দ্য ফ্রেঞ্চ ডিসপাচ’ ছবির একটি দৃশ্যঅফিসিয়াল সিলেকশনে থাকা ছবিগুলোকে লোকার্নো, টেল্লুরাইড, টরন্টো, ডিউভিল, সান সেবাস্তিয়ান, পুসান, নিউ ইয়র্ক, রো, রিও, টোকিও, মুম্বাই এমনকি সানড্যান্স আমন্ত্রণ জানাবে। অস্কারজয়ী ‘টুলেভ ইয়ারস অ্যা স্লেভ’ ছবির নির্মাতা স্টিভ ম্যাককুইনের দুই ছবি নির্বাচিত হয়েছে। এগুলো হলো ‘ম্যানগ্রোভ’ ও ‘লাভারস রক’। কানের একই আসরে একই নির্মাতার দুটি ছবি অফিসিয়াল সিলেকশনে থাকার ঘটনা বিরল।

এ মাসের শেষ সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে ৭৩তম কানের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ও সিনেফঁদাসো বিভাগে নির্বাচিত তালিকা। কান ক্ল্যাসিকসের পুরো তালিকা ঘোষণা করা হবে শিগগিরই। গত ফেব্রুয়ারিতে জানানো হয়, ওঙ কার-ওয়াই পরিচালিত ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ মুক্তির ২০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হবে এবার। এছাড়া উৎসবের ছবি কেনাবেচার আয়োজন মার্শে দ্যু ফিল্ম এবার হবে অনলাইনে।

থিয়েরি ফ্রেমোর কথায়, ‘১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এরপর সম্ভবত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিন মাস ধরে সিনেমা হল বন্ধ। আর কান উৎসব না হওয়ায় এবার সাগরপাড়ের শহরটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সংকটে পড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা সবাই এবার কানের শূন্যতা অনুভব করছি। প্যালে দে ফেস্তিভাল ভবনে ১২ দিনের সমস্ত কিছুর প্রভাব মিস করবো।’

গত একবছরে মৃত্যুবরণ করা তারকাদের স্মরণ করেন থিয়েরি ফ্রেমো, যারা এর আগে কান উৎসবে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮০ সালের আসরে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে বিচারকদের প্রধান কার্ক ডগলাস। ওই বছর সেরা অভিনেতার পুরস্কারজয়ী মিশেল পিকোলির স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। ফরাসি এই অভিনেতা ২০০৭ সালে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারক প্যানেলে ছিলেন। সবশেষ ২০১১ সালে ‘উই হ্যাভ অ্যা পোপ’ ছবির জন্য কানসৈকতে এসেছিলেন তিনি। নিজের স্মৃতিগ্রন্থ ‘আই লিভড ইন মাই ড্রিমস’-এর তত্ত্বাবধানের জন্য কানের সাবেক সভাপতি জিলস জ্যাকবকে দায়িত্ব দেন মিশেল পিকোলি।

২০২০ সালে ইতালিয়ান চলচ্চিত্র গুরু ফেদেরিকো ফেলিনির জন্মশতবর্ষ। কানের সাগরপাড়ে ১২ দিনের আয়োজনে তার তিন শব্দের একটি উক্তি আঁকড়ে ধরা হতো— লিভ দ্য সিনেমা! থিয়েরি ফ্রেমো বিবৃতি শেষ করেছেন এভাবে।


আরো সংবাদ



premium cement