২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

৭০ বছর পর মায়ের বুকে হারানো ছেলে

৭০ বছর পর মায়ের বুকে হারানো সন্তান - ছবি : সংগৃহীত

‘আমার বিশ্বাস ছিল, ছেলে ফিরে আসবে।’ কুদ্দুস বলেন, ‘মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। প্রতীক্ষার দীর্ঘ ৭০ বছর হয়েছে। আজ মায়ের হাত স্পর্শ করলাম, পাশে বসলাম। কতটা প্রশান্তি লাগছে, তা ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছি। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া, দীর্ঘ ৭০ বছর পর হলেও আল্লাহ আমার ইচ্ছে পূরণ করেছেন। আমি পরিবার খুঁজে পেয়েছি, মায়ের বুকে মাথা রাখতে পেরেছি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির একটি মুহূর্ত, কথাগুলো বলেছেন ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামের মৃত কালু মুন্সীর একমাত্র ছেলে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। দীর্ঘ ৭০ বছর পর মা ও ছেলের দেখা হলো। ৮০ বছরের বৃদ্ধ ছেলে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি যখন শতবর্ষী মায়ের হাত ধরে পাশে বসলেন, তখন এই আনন্দময় মুহূর্ত দেখে উপস্থিত কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাববাদ গ্রামে কুদ্দুসের বোন ঝর্না বেগমের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। ৭০ বছর পর মা, বোন ও আত্মীয়স্বজনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা কুদ্দুস। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুদ্দুসের বয়স যখন ৬ থেকে ৭ বছর, তখন বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মা ছেলেকে পড়াশোনার জন্য তার ফুফা পুলিশের দারোগা নবীনগর উপজেলার উপজেলার দীর্ঘশাই গ্রামের আব্দুল আওয়ালের কাছে রাজশাহীর বাগমারায় পাঠান। সেখানে ফুফুর বকা খেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হন কুদ্দুস। ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলের বয়স এখন ৮০ বছর। নিখোঁজ হওয়ার দীর্ঘ ৭০ বছর পর ফেসবুকের কল্যাণে শনিবার মায়ের বুকে ফিরেছেন কুদ্দুস মুন্সি। বর্তমানে জীবিত আছেন কুদ্দুছ মুন্সির মা ও এক বোন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাববাদ গ্রামের দিকে রওনা দেন কয়েকজন।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাঞ্ছারামপুরে পৌঁছান তিনি। কুদ্দুসের ছেলে সোহেল মুন্সী, সোহেলের স্ত্রী, সোহেলের ছেলে-মেয়ে এবং মা-ছেলের পরস্পরকে খুঁজে পেতে সহায়তা করা আইয়ুব আলীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। স্মৃতিচারণা করে কুদ্দুস বলেন, এক দিন ফুফুর বকুনি খেয়ে তিনি বাড়ি থেকে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে যান। ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংহগ্রামে। সেখানে একজন নারীর আশ্রয়ে ছিলেন বেশ কিছু দিন। পরে সিংশাইর গ্রামের সাদেক মিয়ার স্ত্রী তাকে লালন পালন করেন। এরপর বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে বিয়ে করে সেখানেই থেকে যান তিনি। তার ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে রাজ্জাক মুন্সি ইরাকে ও দ্বিতীয় ছেলে জান্নান মুন্সি সৌদি আরব থাকেন। ছোট ছেলে হাফেজ সোহেল মুন্সি বাড়িতেই থাকেন। ৫ মেয়ের সবার বিয়ে হয়ে গেছেন। হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত নিজের পরিবারের সাথে দেখা করার নানা চেষ্টা করে যান কুদ্দুস। অপর দিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার সন্ধান না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিল পরিবার ও স্বজনরা, কিন্তু আশা ছাড়েননি তার মা ১১০ বছরের বৃদ্ধা মঙ্গনের নেছা।

গত এপ্রিলে আইয়ূব আলী নামে একজনের ফেসবুক আইডিতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলেন কুদ্দুস। সেখানে তিনি শুধু বাবা-মা ও নিজ গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড্ডার নাম বলতে পারেন। পরে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড্ডা গ্রামের বাসিন্দারা সাড়া দিতে থাকেন। একপর্যায়ের তার এক ভাতিজা ওই পোস্ট দেখে নিজের হারিয়ে যাওয়া চাচার কথা জানান পরিবারের কাছে। এরপর ফেসবুকে তাদের যোগাযোগ ও কথা হয়।

এরপর নিজের সবকিছু খুলে বলে শেকড় খুঁজে পান তিনি। পরিবারের সদস্যরা বলেন, এ ঘটনায় আমরা অনেক খুশি হয়েছি। দীর্ঘ দিন পর আমাদের আপন মানুষ আমাদের কাছে এসেছে। আত্রাইয়ের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী বলেন, তিনি আবদুল কুদ্দুসকে আগে থেকে চিনতেন এবং মামা বলে ডাকতেন। তার জীবনের গল্প জানার পর অনুমতি সাপেক্ষে তাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট দেন। পোস্টটি তার আপনজনদের নজরে আসে। মাত্র সাড়ে চার মাসে স্বজনের খোঁজ মেলে। মা-ছেলের দেখা হওয়ার দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে এসেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement