২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লালসালুর পুটলিতে মোড়ানো কাঞ্চন নগর হারিয়ে যাওয়ার পথে

লালসালুর পুটলিতে মোড়ানো কাঞ্চন নগর হারিয়ে যাওয়ার পথে - ছবি : নয়া দিগন্ত

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী অর্গানিক পেয়ারা চন্দনাইশের কাঞ্চন নগর হারিয়ে যাওয়ার পথে। সরকারী ও বেসরকারীভাবে এই জাতের পেয়ারা বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে আগামী দুই এক বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে এই অর্গানিক পেয়ারা।

দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রয়োজনে পাহাড় ও পাহাড়ের মাটি কাটা এবং যত্রতত্র পেয়ারা বাগান কেটে মাছের খামার গড়ে তোলা ও ইটভাটার কালো ধোওয়ার কারণে একদিকে পেয়ারার ফলন যেমন কমছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে পেয়ারা বাগানের। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে চট্টগ্রামের নয়, পুরো দেশের অন্যতম অর্গানিক পেয়ারা চন্দনাইশের কাঞ্চন নগর জাতটি হারিয়ে যাবে।

জানা গেছে, ভিটামিন সি-এ ভরা পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ স্বাস্থসম্মত (অর্গানিক) কাঞ্চন নগর জাতের এই পেয়ারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যেও চালান যেত। এক সময়ে পেয়ারার মৌসুম শুরুহলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাটবাজারগুলোতে পাইকারী ও খুচরা পেয়ারা বিক্রেতাদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পেত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে উপরোক্ত কারণে পেয়ার বাগান ও ফলন হ্রাস পেতে শুরু করে যা চলতি মৌসুমে এই প্রভাব আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এবার পেয়ারার ফল গত কয়েক বছরের তুলনায় একেবাওে নিম্ন পর্যায়ে উপণীত হয়েছে।

এক সময়ে বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে টানা চার মাস ধরে বাগানে উৎপাদিত এই পেয়ারা পাওয়া যেত,সেই সাথে পেয়ারা বহন করে বাজারে আনা,খুচরা ও পাইকারী বিক্রির সাথে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো মৌসুম জুড়ে।

এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে নতুন পলি জমার কারণে এখানকার মাটি খুব উর্বর হয়। এর ফলে পেয়ারা চারা রোপন থেকে শুরু করে গাছ বড় হওয়ার পর পেয়ারা ফলন আসা ও পরিপক্ক পেয়ারা সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছের গোড়ায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও গাছে কোনো প্রকার কীটনাশক ছিটানো প্রয়োজন হয় না বাগান মালিক ও চাষীদের। এ কারণে এই পেয়ারাকে স্বাস্থ্যসম্মত বা (অর্গানিক) পেয়ারা বলে। তাছাড়া চাষীরা ডাটা ও পাতাসহ পেয়ারা সংগ্রহ করে এ কারণে ফরমালিন ও রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো ছাড়াই ৪/৫ দিন অনায়াসে এ পেয়ারা সংরক্ষণ করা যায়।

এক সময় মৌসুমে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হতো পেয়ারা চাষী ও শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা, শত শত শ্রমিক কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশের বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে তা বিশেষভাবে লালসালুর পুটলিতে মুড়িয়ে কাঁধে করে নিয়ে আসতেন বাজারে। এরপর লালসালু বাঁধা অবস্থায় থরে থরে সাজানো হতো পেয়ারার সারি। তা দেখে ক্রেতা-বিক্রেতারা সহজেই আকৃষ্ট হতো, এসময় চলতো দরদাম বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখানে পাইকারগণ কিনে শত হিসেবে আর তারা বিক্রি করে ডজন হিসেবে। মৌসুমের শুরুতে প্রতি ডজন পেয়ারা ৮০-১০০ টাকা বিক্রি হয়ে আসছে।

স্থানীয় কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও বোয়ালখালী উপজেলায় অন্তত ১০-১২ হাজার একর পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে হাজার হাজার পেয়ারা বাগান ছিল। এখন সেই পরিমান পেয়ারা বাগান নেই।

জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রাম জুড়ে এই পেয়ারা চাষ হলেও মূলত চন্দনাইশ উপজেলাই হলো কাঞ্চন নগর জাতের পেয়ারার উৎপত্তিস্থল। এখানকার পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বিশেষ করে হাশিমপুর, জঙ্গল হাশিমপুর, ছৈয়দাবাদ, লট এলাহাবাদ, কাঞ্চননগর, দোহাজারী, ধোপাছড়ি ও ধোপাছড়ি, পটিয়ার কেলিশহর, হাইদগাও, শ্রীমাই এলাকার উৎপাদিত পেয়ারা সর্বোৎকৃষ্ট মানের পেয়ার উৎপন্ন হয়ে আসছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানা গেছে, প্রতি মৌসুমে পেয়ারা বাগানগুলোতে হেক্টর প্রতি গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মেট্রিক টন করে পেয়ারা উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হতো। মৌসুমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠা দোহাজারী, বাগিচা হাট, খাঁন হাট, কাঞ্চননগর, চক্রশালা, হামিশপুর, বাদামতল, রৌশন হাট ও কমল মুন্সির হাট এলাকায় রীতিমতো বসতো পাইকারী পেয়ারার হাট বা বাজার এখনো বসছে তবে তা সীমিত আকারে। উপরোক্ত কারণে গত কয়েক বছর ধরে পেয়ারার বাগান যেমন কমে আসছে, তেমনি পেয়ারার ফলনও কমে আসছে। চলতি মৌসুমে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এবার উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসছে বলে পেয়ারা বাগান মালিক ও চাষীরা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, সরকারীভাবে এই পেয়ারার জাত সংরক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে আগামী দুই এক বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু অর্গানিক পেয়ারা একেবারেই হারিয়ে যাবে।

কৃষি অধিদফতর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক আকতারুজ্জমান বলেন, জুলাই থেকে শুরু করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এক টানা চার মাস এই সুস্বাদু এ পেয়ারা পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, এখানে প্রতি হেক্টর বাগানে গড়ে ১৬ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলের চাষীরা পেয়ারা গাছে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ছিটায় না। তাছাড়া পেয়ারা সংরক্ষণেও কোনো প্রকার ফরমালিন বা মেডিসিন ব্যবহার করে না বলে তিনি এ অঞ্চলের উৎপাদিত পেয়ারাকে খুবই স্বাস্থ্যসম্মত বা অর্গানিক বলে আসছেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, উপজেলা পর্যায় চাষী ও বাগান মালিকদের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement