২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সোনার আলোয় ভরিয়ে দিলো সোনা বরণ সোনালু

সোনা বরণ সোনালু - ছবি : সংগৃহীত

গাছ ভর্তি হালকা সবুজাভ পাতা আর মখমলে হলুদের মিশেল। থোকা থোকা ফুল ঝাড়বাতির মতো ঝুলে আছে শাখায় শাখায়। অথবা কোনো তরুণীর কর্ণে জড়িয়ে থাকা হলুদ গুচ্ছ। দেখে মনে আসবে নজরুলের সেই গানের কলি, ‘কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথি চৈতী চাঁদের দুল’। গনগনে রৌদ্রতাপেও এমন প্রশান্ত সৌরভ নিয়ে আসে সোনা বরণ সোনালু। সূর্যের প্রখরতায় যখন জ্বলছে ধরণী, তখনি একরাশ হলুদের স্নিগ্ধতা নিয়ে ধরায় এসেছে এই সোনালু ফুল।

গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়ছে চারদিক। কিন্তু উল্টো রূপ সোনালুর বেলায়। প্রখর রোদে ছাই ভস্ম হওয়া দূরে থাক, সোনালুর রূপ আরো যেন ঝরে পড়ছে এই প্রখরতায়। কাঁচা সোনা রঙে সবার নজর কেড়ে নিচ্ছে। ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ পথিক নিজের অজান্তেই গেয়ে ওঠেন- এ কী সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে...।

মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ বছর ও সোনালু সেজেছে নয়নাভিরাম ভিন্ন মাত্রায়। মহামায়া, করেরহাট, সোনাপাহাড়, ওয়াহেদপুর, খৈয়াছরা ছাড়া ও মিরসরাই পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে এই গন্ধহীন ফুল তার পাঁচটি পাপড়ি মেলে মাঝের পরাগদণ্ড রূপ মেলে আছে প্রকৃতির পানে। পাতা হালকা সবুজাভ, মধ্য শিরা স্পষ্ট। গাছের শাখা-প্রশাখা কম, কাণ্ড সোজাভাবে ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। বাকল সবুজাভ থেকে ধূসর রঙের আর কাঠ মাঝারি শক্ত।

মিরসরাইয়ে এই ফুল বান্দরলাঠি নামেই বেশি পরিচিত! ইংরেজি নাম- Golden Shower Tree, বৈজ্ঞানিক নাম- Cassia fistula। Caesalpiniaceae পরিবারের সদস্য।

আদিনিবাস পূর্ব এশিয়া। তবে হাজার বছর আগেও এ গাছ আমাদের উপমহাদেশে ছিল। কালিদাসের মেঘদূতে এই ফুলের গুণ-কীর্তন করা হয়েছে। সোনালু গাছের বাকল পাতায় ওষুধি গুণাগুণ রয়েছে। সোনালু ঠিক এই মুহূর্তের অর্থাৎ গ্রীষ্মের ফুল। বৈশাখে ফোটে। এখন সবচেয়ে বেশি প্রস্ফুটিত অবস্থায় দৃশ্যমান। খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। পথে হাটতে হাটতে চোখে পড়ে। সত্যি আশ্চর্য সুন্দর ফুল!

এই সময়ে মিরসরাই উপজেলা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। প্রকৃতিপ্রেমীরা দারুণ উপভোগ করছেন। সোনালু ফুলের গাছ আম-জাম গাছের মতোই উচুঁ। ডালপালা চারপাশে ছড়ানো থাকে। বিশেষভাবে চেনা যায় ফুল ফোটার মৌসুমে। কাছ থেকে দেখলে ফুলটির পাপড়ির রঙ প্রায়শই কাঁচা হলুদ দেখায়। ঘন ফুলে ভর্তি গাছ দেখে মনে হয় কেউ বুঝি হলুদ রঙের কৌটো উপুড় করে দিয়েছে! গ্রীস্মের প্রখর রোদ ফুলের গায়ে পড়লে রংটি সোনালি মনে হয়।

সোনালু বাংলাদেশে এসেছে পূর্ব ভারত থেকে। ফলের আকার আকৃতি আমলে নিয়ে সোনালুকে ‘বানরলাঠি’ বলেও ডাকা হয়! সোনালুর ফল ও গাছের পাতা বানরের প্রিয় খাবার। এ কারণেও একে ‘বানরলাঠি’ বলা হয়ে থাকে। সোনালু, সোঁদাল এসব নামেও পরিচিত। এর ফলগুলো এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ব্যাস দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ দেখতে হয়। পাকলে কালচে লাল।

এ ফুলের আদিনিবাস হিমালয় অঞ্চল ধরা হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এর বিস্তৃতি। অস্ট্রেলিয়ায় নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুন্সল্যান্ডের উষ্ণ অঞ্চলে এদের প্রচুর দেখা মেলে। পত্রঝরা বৃক্ষে, শীত গাছের সমস্ত পাতা ঝরে গিয়ে গাছ থাকে পত্রশূন্য এবং বসন্তের শেষে ফুল কলি ধরার পূর্বে গাছে নতুন পাতা গজায়। গ্রীষ্মে গাছের শাখা প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফোটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্মকাল পুরো সময় জুড়ে।

ফুলের পাঁপড়ি পাঁচটি, সবুজ রঙের একমাত্র গর্ভকেশরটি কাস্তের মতো ঝুলতে থাকে।
প্রকৃতিকে নয়নানভিরাম রূপে সাজাতে এবং প্রকৃতির শোভা বর্ধনে সোনালু গাছ সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়। শুধু বাংলাদেশ নয় বিভিন্ন দেশে শোভাবর্ধনে এই গাছ লাগানো হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে যখন সব গাছে একসাথে সোনালী ফুল ফোটে, তখন মনে হয় সোনালী আলোকচ্ছটায় চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে।

সোনালুর কিছু ওষুধিগুণও আছে। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে সোনালুকে বলা হয় ‘ডিজিস কিলার’। সোনালু ফলের পালপকে কোষ্ঠ পরিষ্কারক বা রেচক বলে বিবেচনা করা হয়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ফলের ভিতরকার নরম অংশ মাইল্ড ল্যাক্সসেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জ্বর কমানোর জন্য, আরথ্রাইটিস এবং নার্ভের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় সোনালু। সব রকমের রক্তপিত্ত, হার্টের সমস্যা এবং স্টোমাকের সমস্যা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় সোনালু। এছাড়া সোনালু গাছ মৌমাছি পালনের জন্য খুবই উপযোগী। এই গাছকে বাতাসের প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই গাছ থেকে খুবই উন্নত মানের চারকোল এবং ট্যানিন পাওয়া যায় এবং সোনালুর পাতা তৈরি হয় ভালো জাতের সার তৈরি হয়।

সোনালুর ছাল, পাতা ও ফলের মজ্জা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার ও ভাইরাস প্রতিরোধে কাজে আসে। এ ছাড়া ডিপথেরিয়া কুষ্ঠরোগের ক্ষত চিকিৎসায় কার্যকর।


আরো সংবাদ



premium cement