রেমালে নিঃস্ব রুনু-আলাউদ্দিনরা, চোখের পানিই এখন আকুতি!
- রবিন আহম্মেদ, সাগরপাড়ের নয়ারচর (রাঙ্গাবালী) থেকে ফিরে
- ০১ জুন ২০২৪, ১৮:৫০
সাজানো সংসার ছিল মধ্যবয়সী রুনু-আলাউদ্দিন দম্পতির। কিন্তু সব হারিয়েছেন ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাণ্ডবে। চোখের সামনেই মুহূর্তে মাথা গোঁজার একমাত্র ঘরটি দুমড়ে-মুচড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘরের চিহ্ন বলতে এখন আছে শুধু তাদের ভিটেমাটিটুকুই। তাই নির্বাক হয়ে স্বামী-স্ত্রী বসে আছেন খালি ভিটাতেই।
দুই শিশু সন্তান আর শ্বশুরকে নিয়ে এখন তাদের দিন কাটছে মানবেতর। রান্নাবান্না করার মত অবস্থাটুকুও নেই। প্রতিবেশীদের দয়াতেই চলছে দিন। একেকদিন একেক বাড়িতে রাত্রিযাপন করছেন তারা। টেনেটুনে সংসার চালানো জেলে পেশায় নিয়োজিত আলাউদ্দিনের ঘুরে দাঁড়ানোও এখন অসম্ভব। এ বিষয়ে রুনু বেগমের সাথে প্রতিবেদক কথা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
চোখের অশ্রু ঝড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘ভাইরে কি দিখতে আইছেন। আমাগো যে কিছুই নাই। এই বইন্যায় (ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস) আমাগো সব নিয়া গ্যাছে (গেছে)।’
আর্তনাদ করে রুনু বেগম বলেন, ‘আমরা নদীর পাড়ে থাহি। আমাগো জায়গা সম্পত্তি কিছুই নাই। এই বাঁধের ধারে ঘর করে থাকছিলাম। হেই ঘরডাও নিয়া গ্যালো। মালছামানা কিছুই নাই। আর জীবনডা লইয়া বাইচা আছি। শুধু ভিটা পইড়া রইছে। পোলাপান লইয়া অনেক কষ্টে আছি। ঘরবাড়ি ওঠানোর মতো সামর্থ্য নাই।’
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নের সাগরপাড়ের গ্রাম নয়ারচরে গিয়ে রুনু ও আলাউদ্দিন দম্পতির এমন দুর্দশা চোখে পড়েছে।
শুধু তারাই নয়, ওই গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সময় গড়াতেই এখন বেড়িয়ে আসছে সেইসব ক্ষতচিহ্ন। ঘরবাড়ি হারিয়ে এমনও কয়েকটি পরিবার রয়েছে, যারা নিঃস্ব। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপর। সরেজমিনে বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত এসব এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখেছেন এ প্রতিবেদক।
স্বামীহারা ৮০ বছরের বৃদ্ধা সুফিয়া বেগম। তার ঘরটিও কেড়ে নিয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। এখন বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের ছাপড়া দিয়ে বসবাস করছেন তিনি। তার সাথে আরেকটি পলিথিনের ছাপড়া দিয়ে বাস করছেন তার ছেলে-পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনি।
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘কোনোরকম পলিথিন দিয়া মুড়া (ছাউনি) দিয়া থাহি (থাকি) বাবা। রানতে বাড়তে পারি না। হাড়ি-পাতিল সব নিয়া গেছে। চুলা নাইও। কোনোমতে ইট দিয়া চুলা বানাইয়া হ্যানে-ভ্যাতে খাই। খাতা বালিশ, জামা-কাপড় যা আছে সব ভিজা।’
বৃদ্ধ শাহিনুর-বাবুল দম্পতির ঘরটি দুমড়ে-মুচড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। দুই ছেলে-দুই মেয়ে আর নাতি-পুত্রবধূসহ তাদের আটজনের সংসার। ঝড়ের পর থেকে তাদের সেই সংসারে খাবার জুটছে না। খেয়ে না খেয়ে কাটছে দিন। বৃহস্পতিবার দুপুরেও রান্না হয়নি তাদের। তাই শাহিনুর চাল ভেঁজে দিয়েছেন সবার জন্য। সেই চালভাজা খেয়েই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ঘরটি ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছেন পরিবারের সবাই।
ভিটেমাটি হারিয়েছে জেলে শাহজালাল মাঝি। তার মা, স্ত্রী আর ছয় সন্তানসহ ৯ সদস্যের সংসার। ঘরে রান্নাবান্নার মত কোন অবস্থাই নেই। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছেলে-মেয়েদের পানিতাল কেটে খেতে দিয়েছেন। অনাহারে থাকা ছেলে মেয়েরা সেই পানিতাল খেয়েই পেটের ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহজালাল।
তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে আমাগো সব নিয়া গেছে। এমন কষ্ট আছি যে বলে বুঝানো যায় না। প্রধামন্ত্রীর কাছে আমাগো আকুল আবেদন। আমাদেরকে তিনি যেন থাকার মতো একটা মাথাগোঁজার স্থান করে দেন। বাচ্চাগাচ্চা নিয়া আমি যেন একটু থাকতে পারি। আমার মতো এমন অনেক মানুষ আছে, তাদের জন্যও তিনি যেন একটা ব্যবস্থা করেন।’
এমন অবস্থা শুধু রুনু-আলাউদ্দিন, শাহিনুর-বাবুল কিংবা সুফিয়া, শাহজালারেই নয়, নয়ারচর গ্রামের কমবেশি অনেকেরই জীবন এমন দুর্বিসহ অবস্থা। বঙ্গোপসাগরের তীরের এ গ্রামে রীতিমত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। আর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়েছে বেড়িবাঁধ ভেঙে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার কারণে। বাঁধ ভেঙে অনেকেরই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরটিও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় কেউ কেউ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন।
শুধু নয়ারচর নয়, চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা, বউ বাজার, দক্ষিণ চরমোন্তাজ এবং চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নসহ উপজেলার প্রায় চরাঞ্চলে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারো বসত ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, কারো একেবারেই বাড়ি-ঘর নিচিহ্ন হয়ে গেছে । কারো ঘর কোনোমতে টিকে থাকলেও নেই ছাউনি কিংবা টিন। কারও ঘর দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই ভিটেমাটি। এখন কিভাবে এসব মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেন এমন দুশ্চিন্তায় পার করছেন প্রতি মুহূর্ত।
প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙ্গাবালী উপজেলায় সাড়ে আট হাজার ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি পুকুর ও ঘেরের মাছ। এতে ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা। মারা গেছে ৫৭৭টি গবাদিপশু। এতে সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৩০০। আর মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ টাকা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অজিত কুমার দেবনাথ বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেড় হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩২০ মেট্রিকটণ চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেসব চাল পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার রাস্তাঘাট এবং বেড়িবাঁধ মেরামত ও দুর্গতদের সহায়তার জন্য ধাপে ধাপে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আসায় ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন দুর্গতরা। তাদের বিশ্বাস, তাদের পাশে দাঁড়াবেন প্রধানমন্ত্রী। পাবেন মাথা গোঁজার ঠিকানা, হবে টেকসই বেড়িবাঁধ; এমন আশাতেই বিভোর এসব দুর্গত মানুষেরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুক্রবার দিনভর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিব্বুর রহমান রাঙ্গাবালী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মাঝে তিনি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
দুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মো: মহিব্বুর রহমান বলেন, ‘এই ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। রাস্তাঘাট নষ্ট হয়েছে। পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। কোটি কোটি টাকার তাদের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের মন্ত্রণালয়সহ অন্য মন্ত্রণালয় এসব এলাকার ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট পৌঁছে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এসব রাস্তাঘাট ঠিক করা, বেড়িবাঁধ মেরামত করা, যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া, যারা গৃহহীন হয়েছেন, তাদের বাড়িঘরের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। ত্রাণ বিতরণ চলছে। প্রয়োজন অনুযায়ী ঢেউটিন বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সুতরাং কোনো মানুষ কষ্টে থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব মানুষের পাশে আছেন। সে লক্ষে আমরা কাজ করছি।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা