২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রতিকূলতার বেড়াজালে বন্দী মারুফার স্বপ্ন

মারুফা মাহিয়া - ছবি - নয়া দিগন্ত

জীবনের গল্পগুলো একটু অদ্ভুতই হয়। কোন পথে গিয়ে গল্পগুলো রঙ বদলাবে, সেটা কেউ বুঝেই উঠতে পারে না। খারাপ সময় শক্ত হাতে মোকাবিলা করাই জীবনের স্বার্থকতা। এই যুদ্ধে পিছপা হতে নেই। জীবনের যেকোনো লগ্নে এসে সফলতা ধরা দিতে পারে, সেই অপেক্ষায় আপনাকে দৌঁড়াতে হবে। এমনই একজন ‘মারুফা’। যে হারার আগে হার মানতে রাজী না।

পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জের দেউলী গ্রামের হাটুরে দোকানী মোঃ বেলাল হোসেনের মেয়ে মারুফা। পুরো নাম মোসাঃ মারুফা মাহিয়া রূপা। দেউলী পল্লী মঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এবারে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

তিন ভাই-বোনের সংসারে মা যখন আর্থাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন বড় মেয়ে হিসেবে মারুফার পড়া-লেখার স্বপ্ন তখনই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই প্রতিকূলতাকে জয় করে স্বপ্ন দেখেন এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে দরিদ্র বাবা ও অসুস্থ মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর। কারো জীবনে কখনো যদি দমে যাওয়ার ভয় জাগে, তাহলে মারুফার জীবনের গল্প তাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।

সময়টা ২০১০ এর মাঝামাঝি। সবে মাত্র পাঁচ বছরে পা দিয়েছে মারুফা। বাবা ভাবছিলেন এ বছরই তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। কিন্তু তার জীবনে তখনই প্রতিবন্ধকতার বোঝাটি চেপে বসে। মা হঠাৎ করেই দূরারোগ্য আর্থাইটিসে আক্রান্ত হয়ে পরেন। চলাফেরার শক্তি হারিয়ে বিছানায় পরে যান তিনি। হাটে (বাজার) গেলে রান্না করে রেখে যেতে হতো বাবা বেলাল হোসেনকে। এভাবে স্ত্রীর দেখা-শোনা করতে গিয়ে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তার। সংসারে নেমে আসে অভাব-অনাটন। স্ত্রী-সন্তানের মুখে আহার জোটাতে হাটে গেলে সেদিন না খেয়ে থাকতে হতো তাদের। বাবা হাট (বাজার) থেকে এসে রান্না করলে তখন খাবার জুটতো পরিবারের সবার। দিন দিন এ সকল প্রতিকূলতার সাথে মোকাবিলা করতে করতে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মারুফা। বাবাও মেয়েকে নিয়ে আশা ছেড়ে দেন বড় কিছু হওয়ার। সেই থেকেই স্বপ্ন-ভঙ্গ হয় তার। বাবাকে রান্নায় সাহায্য করতে করতে সে শিখে নেয় পরিবারের সকল কাজ। কিন্তু শিক্ষকরা তার মেধা দেখে তাকে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। এরই মধ্যে তিন ও সাত বছরের মাথায় তার আরো দু-ভাই বোনের জন্ম হয়। তাদের দেখা-শোনা করা ও সংসারের কাজ গোছাতে গিয়ে লেখা-পড়া তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় লেখা-পড়াটা চালিয়ে যায়। হাল ছাড়ে না সে।

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে তার স্বপ্নটা বাস্তবে রুপ নেয় যখন সে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায়। নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এভাবে চলতে থাকে তার পড়া-শোনা। সে বছর যখন তার দ্বিতীয় বোন মনিরার জন্ম হয় তখন তার প্রতি পরিবারের অবহেলা যেন বেড়ে যায়। এক দিকে দারিদ্রতা অন্য দিকে পারিবারিক অবহেলা, এই দুটো যেন তার সাংসারিক কাজ সামলানোর আগুনে ঘি-ঢালতে শুরু করে। বাবার সামান্য আয়, মায়ের অসুস্থতায় খরচ জোগানো এসবের কথা ভেবে বিজ্ঞান বিভাগ নেয়নি সে। কেননা সবাই তাকে বুঝিয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ নিলে তিন-চারটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হবে, সে খরচ জোগানো ও সংসারের খরচ তার বাবার পক্ষে তা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। এর মধ্যে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় যখন স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে সে ভেবেই নিয়েছিলো এই বুঝি তার পড়াশোনা শেষ। তখন সে নিজে নিজে কাজের ফাঁকে এমনকি রান্না করতে করতে অথবা ছোটো বোন বা ভাইকে এক হাতে কোলে নিয়ে অন্য হাতে বই নিয়ে মারুফা অধ্যায়ন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবে পড়া লেখা করেই সে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সবার ভাবনা অন্য থাকলেও সে জিপিএ-৫ পায় মারুফা। সবার পাশাপাশি তার মুখে হাসি ফুটলেও সে হাসি আর দীর্ঘ হলো না। তার স্কুলের সহপাঠিদের ভালো কলেজে ভর্তি হলেও তার হবে না। কেননা অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা ও সংসারের কাজ কে জোগান দেবে?

দূরের কলেজে ভর্তি হলে হোস্টেলে থাকা , প্রাইভেট পড়া, হাত খরচ সব মিলিয়ে তার পড়াশোনার পিছনে যে ব্যয় হবে তা বহন করার সক্ষমতা তার দরিদ্র পিতার নেই। এর পরও তার আরো দুটি ভাই-বোন আছে। বোনটি এ বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ভাইটির বয়স চার বছর তাদের পিছনেও খরচ তো রয়েছে। ছোট ভাই যখন স্কুলে ভর্তি হবে হয়তো তখন তাকে টিউশনি করে পরিবারের খরচ জোগান দিতে হবে। কেননা তার বাবার প্রতি হাটের দিনের (সপ্তাহে ২ দিন) আয় মাত্র প্রায় চার থেকে সাড়ে চার শ’ টাকা। স্ত্রী’র চিকিৎসা বন্ধ রেখেও এই টাকা দিয়ে তার বাবা পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কী দিয়ে তার ভবিষ্যৎ পড়ালেখার ব্যয় নির্বাহ হবে এই নিয়ে ভাবতেই তার দিন যাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ছোট্ট ভাঙ্গা চৌচালা একটি ঘরে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে ধান সিদ্ধ করছে মারুফা। অসুস্থ মা বিছানায় শুয়ে আছেন। বাবা হাট (বাজার) থেকে ফিরেছেন।

ভবিষ্যতে কী হতে চাও এমন প্রশ্নের উত্তরে মারুফা জানায়, মানবিক বিভাগ থেকে পাস করেছি কী আর হবো! যদি পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাই তবে অ্যাডভোকেট হওয়ার ইচ্ছা আছে।’
আরো জানায়, ‘কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করেছি। ভালো কলেজে তো আর ভর্তি হতে পারবো না। স্থানীয় কোনো কলেজে চান্স পেলেই হবে।’

তার বাবা বেলাল হোসেন জানান, ‘মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার অপেক্ষায়। মেয়েদের বেশি পড়িয়ে লাভ কী! বিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব করিয়েছি। ওরে যতটুকু পড়িয়েছি অন্য দুইটারেও ততটুকু নিয়া লই।’

ভালো কলেজে ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘মেয়েদের দূরে না দেয়াই ভালো। ঘরের খাইয়া যতটুকু পারে ওইটাই যথেষ্ট।’

বাবার বক্তব্যে স্পষ্ট, মেয়ের উচ্চশিক্ষায় তার আগ্রহ নেই। অথচ মারুফা স্বপ্ন বুনে চলেছে। যেভাবে আগেও বুনেছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়েছে। এখন নতুন স্বপ্নে নানা প্রতিকূলতা বাধ সাধবে। এভাবেই প্রতিকূলতার বেড়াজালে বন্দী মারুফার স্বপ্ন!

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement