২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পায়রা সেতু চালু, সুবিধা অসুবিধা

- ছবি : সংগৃহীত

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সাথে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতু বোরবার উদ্বোধন করা হয়েছে। পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুটি দেশের পঞ্চম বৃহত্তম সেতু বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।

রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতুটির উদ্বোধন করেন। দুপুর থেকেই এই নদীতে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও কুয়াকাটা সড়কের দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকায় পায়রা নদীর ওপর এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।

আগামী বছর থেকে পদ্মাসেতু চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সেটি চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোয় সড়ক পথে চলাচলে আর কোনো ফেরি থাকবে না।

উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যোগাযোগ উন্নত হলে আর্থসামাজিক উন্নতিটাও তরান্বিত হবে। ...এটা ঠিক যে, পায়রা সেতু- যদি আমি নিজে উপস্থিত থেকে ওই সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে একটু যেতে পারতাম বা ওই সেতুতে নেমে যদি একটু দাঁড়াতে পারতাম, পায়রা নদীটা দেখতে পারতাম, যে নদীতে আমি সবসময় স্পিডবোটে চড়েছি, সেখানে যদি একটু ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারতাম, তাহলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু করোনার কারণে সেটা হলো না।’

তবে এই সেতু তিনি একদিন দেখতে যাবেন বলে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

পায়রা সেতুর গুরুত্ব কী?
বরগুনার আমতলীর বাসিন্দা রেহানা আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এক সময় ঢাকা থেকে আমতলী আসতে হলে আটটি সেতু পার হতে হতো। শুধু বরিশাল থেকেই পার হতে হতো চারটি সেতু। এই সেতুটি হয়ে যাওয়ার পর পদ্মা নদী ছাড়া ঢাকার সাথে যোগাযোগে আর কোনো সেতু রইল না।

তিনি বলেন, কখনো কখনো যানজটে পড়ে এই ফেরিঘাটেই দিন পার হয়ে যেত। ঝড় বৃষ্টি হলে ফেরি বন্ধ থাকত। কিন্তু এখন আর আমাদের পথে কোনো বাধার মুখে পড়তে হবে না।

গত কয়েক বছরে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল পায়রা নদী। এখানে ফেরি পার হতে এক বা দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। কখনো কখনো সময় আরো বেশি লাগত।

পায়রা সেতু প্রকল্পের পরিচালক আবদুল হালিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এই সেতুর ফলে পায়রা নদীবন্দর ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সাথে সড়ক পথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি হলো। কাউকে পথে আর কোনো বাধার মুখে পড়তে হবে না। ফেরিতে যে সময় ব্যয় হতো, যে যানজট হতো, তা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে।

এর ফলে বেশ কিছু সুবিধা আসবে বলেও তিনি মনে করছেন। তার কথায়, সেগুলো হলো- এসব এলাকায় শিল্পায়ন হবে, ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য এলাকার পর্যটন বিকশিত হবে। সবমিলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পায়রা নদীবন্দর পুরোপুরি ব্যবহার করা শুরু হলে মালামাল বহনের ক্ষেত্রে এই সেতুটি বড় ভূমিকা রাখবে। এর ফলে যান চলাচলে কোনো বিঘ্ন তৈরি হবে না।

রেহানা আক্তারও বলছেন, পায়রা বন্দর হওয়ার পর এদিকে জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভালো হয়েছে। পদ্মাসেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গে অনেকেই কলকারখানা করতে আসবেন বলে আশা করছি। তখন নিশ্চয়ই এদিকে চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যের অনেক উন্নতি হবে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলছেন, আগে দূরত্বের কথা, ভোগান্তির কথা ভেবে অনেক মানুষ কুয়াকাটায় আসতে চাইতেন না। কিন্তু এখন সেতু হয়ে যাওয়ায় পর্যটকরা আগ্রহী হবে। তারাও দ্রুত আসা-যাওয়া করতে পারবেন।

তিনি আশা করছেন, সামনের বছর পদ্মাসেতু হয়ে গেলে তখন পায়রা সেতুর শতভাগ সুবিধা ভোগ করা সম্ভব হবে। কারণ তখন আর কোনো ফেরি না থাকায় ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে বলে তার প্রত্যাশা।

নতুন প্রযুক্তি যোগ হয়েছে পায়রা সেতুতে
সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম বলছেন, এই সেতুতে নতুন কিছু বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। যেমন ব্রিজ হেলথ মনিটর সেন্সর যুক্ত হয়েছে। এই সেন্সর মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্পের শকটা ট্রান্সমিট করবে। ঝড়, সাইক্লোন, তাপমাত্রা বা ওভারলোডিংয়ের কারণে ব্রিজের যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সেটা আমাদের সিগন্যাল দেবে। তখন আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবো।

তিনি বলেন, সেতুর ক্ষতি হতে পারে, এমন ভারী যানবাহন উঠলে সাথে সাথে এটি বিপদ সঙ্কেত পাঠাতে শুরু করবে। এই ব্রিজটি সর্বোচ্চ স্প্যান বিশিষ্ট ব্রিজ, যেটির নদীতে একটি মাত্র পিলার রয়েছে। এর ফলে এর নিচ দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতে পারবে।

পদ্মাসেতু বিবেচনায় নিলে ১.৪৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি দেশের পঞ্চম দীর্ঘতম সেতু বলে তিনি জানান।

সেতু নির্মাণের শুরুর কথা
২০১২ সালের ৮ মে এই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। পরের বছর ১৩ মার্চ এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

বাংলাদেশ সরকার, কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে তৈরি সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪৭০ মিটার বা ১.৪৭ কিলোমিটার। পুরো সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছে এক হাজার ১১৭.৮১ কোটি টাকা।

বেশি টোল নির্ধারণের অভিযোগ
তবে পরিবহন মালিকরা অভিযোগ করছেন, আগে ফেরিতে তাদের যে পরিমাণ টোল দিতে হতো, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টোল নির্ধারণ করা হয়েছে সেতুতে।

পটুয়াখালী বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি মো: রিয়াজউদ্দিন মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আগে ফেরিতে একটি বাস পরিবহনে আমরা টোল দিতাম ৫০ টাকা। সেটা সেতুতে নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪০ টাকা। এটা আমাদের জন্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি টোল ধরা হয়েছে। কিন্তু আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে যে ভাড়া নেই, তার সাথে তুলনা করলে এই টোল অনেক বেশি।

তিনি জানান, এই বিষয়ে তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

তবে প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম বলছেন, সেতুর টোল নির্ধারণে সরকারি যে নীতিমালা রয়েছে, সেটা মেনেই নতুন টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। সেতু নির্মাণ খরচ, নান্দনিকতা, সময় সাশ্রয় ইত্যাদি দিক বিবেচনায় নিয়ে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ফেরির চেয়ে সেটা একটু বেশি হলেও খুব বেশি বলা যাবে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement