ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রামগড়ের শিক্ষাব্যবস্থা
- বেলাল হোসাইন রামগড় (খাগড়াছড়ি)
- ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৭
- ভয়াবহ শিক্ষক সঙ্কট
- ধার করা খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে চলছে ক্লাস
- মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে ৭ পদে রয়েছেন মাত্র ২ জন
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের শহর রামগড়। সৌন্দর্যের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও বেশ এগিয়েছিল রামগড়। এই শহরের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সঙ্কট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অভিভাবকরা। অফিস সহকারী দিয়ে পুরো উপজেলার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর লেখাপড়া।
রামগড় মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে অনুমোদিত বিদ্যালয় এবং মাদরাসার সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৭টি শিক্ষক পদের স্থলে শিক্ষক সংখ্যা ৯ জন। শূন্যপদের সংখ্যা আটটি। এর মধ্যে আবার খণ্ডকালীন শিক্ষক দুইজন। রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১টি শিক্ষক পদের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১১ জন। শূন্যপদের সংখ্যা ১০টি। খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন সাতজন। রামগড় বলিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৭ জনের পরিবর্তে শিক্ষক রয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে খণ্ডকালীন পাঁচজন। একই দুরবস্থা চৌধুরীপাড়া জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় এবং নাকাপা উচ্চ বিদ্যালয়েও।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ে দুই মাস ধরে মাধ্যমিক কর্মকর্তা নেই। সাতটি পদে রয়েছেন মাত্র দুইজন। একজন অফিস সহায়ক এবং একাডেমিক সুপারভাইজার দিয়ে পুরো উপজেলার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
রামগড় সরকারি ডিগ্রি কলেজের অবস্থা আরো ভয়াবহ। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিএ পর্যন্ত ২২ জন শিক্ষকের মধ্যে রয়েছেন ১২ জন। বিভাগভিত্তিক অধিকাংশ শিক্ষক পদই শূন্য। কোনো বিভাগেই পরিপূর্ণ শিক্ষক নেই। গণিত বিভাগের শিক্ষক না থাকায় গত চার মাস ধরে কোনো ক্লাসই হয়নি। এর মধ্যে গণিত, দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তিনজন শিক্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে থাকায় শিক্ষক সঙ্কটের কারণে পাঠদান পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে।
রামগড় সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মংশাজাই মারমা বলেন, প্রায় সময় কোনো না কোনো পদ খালি থাকে। যেমন এখনো মানবিক বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কোনো শিক্ষক নেই। দীর্ঘদিন ধরে উপাধ্যক্ষের পদ ও শূন্য রয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষক থাকা বাঞ্ছনীয়। অথচ পদ সৃজিত থাকলেও আইসিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো শিক্ষকই দেয়া হয়নি। একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করা হলেও কয়েক মাস আগে তারও অন্যত্র চাকরি হয়েছে। তিনি আরো জানান, বর্তমান অধ্যক্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের হওয়ায় তিনি প্রায় দুই বছর ক্লাস নিয়ে আসছিলেন। তিনিও আগামী ২ জুন পিআরএলে চলে যাবেন। আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে বাংলা একজন, হিসাববিজ্ঞান একজন, অর্থনীতি একজন, প্রাণিবিদ্যা একজন জয়েন করার কথা রয়েছে ৪১তম বিসিএস থেকে। যদি তারা জয়েন করে তার পরও ছয়টি পদ বাকি থাকবে।
রামগড় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদ রয়েছে ২৫৭টি। ৪১টি শিক্ষক পদ এখনো শূন্য। উপজেলার ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। উপজেলার বালুখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গুঁজাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন করে শিক্ষক দিয়ে কয়েকশ’শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হচ্ছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষক সঙ্কটে শিক্ষার মান তলানীতে। স্বল্প টাকায় খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে লেখাপড়া পরিচালনা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়গুলোতে বিভাগভিত্তিক শিক্ষক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সদ্য পড়াশোনা শেষ করে আসা অনভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। রামগড় সরকারি ডিগ্রি কলেজে গিয়ে দেখা যায় পুরো কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষক না থাকায় স্থানীয় কোচিংগুলোতে পড়ে জোড়াতালি দিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। অভিভাবক শ্যামল রুদ্র উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, সন্তানদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই চিন্তিত। রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষক সঙ্কট চরমে। শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার মান ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের টানা ক্লাস নিতে হয়। অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ সামলানোর পাশাপাশি পরীক্ষার খাতা দেখাসহ নানা কাজে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রয়োজনে ছুটিও নেয়া যায় না।
রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের কারণে শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কোনোরকম শিক্ষাদান এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষার এই দুরবস্থা দেখে রামগড়ের সন্তান কাস্টমস কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে রামগড় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। নব্বই দশকেও রামগড়ের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক পদ শূন্য ছিল না। অথচ বর্তমানে শিক্ষক সঙ্কটে শিক্ষার্থীরা সন্তোষজনক ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ।
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কারবারি বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। একাধিকবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে শিক্ষক সঙ্কটের কথা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী ব্যস্ততা কেটে গেলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নিয়ে শিক্ষক সঙ্কট কাটিয়ে রামগড়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিবেন।
খাগড়াছড়ি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোসলেম উদ্দীন জানান, রামগড়ে শিক্ষক সঙ্কটের কথা তিনি শুনেছেন। মাস দুয়েকের মাঝে উপজেলার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কট কেটে যাবে বলে জানান তিনি। আর বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সঙ্কট কাটাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা