২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘুষ দিলে সবই হয় লক্ষ্মীপুর সাব-রেজিস্টার অফিসে, না দিলেই হয়রানি

লক্ষ্মীপুর সাব-রেজিস্টার অফিসে আগতদের ভিড় : নয়া দিগন্ত -

লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অবাধে চলছে ঘুষ বাণিজ্য। প্রতিটি কাজেই বড় অঙ্কের টাকা ঘুষ দেয়া নিয়মে পরিণত হয়েছে এই অফিসে। রেজিস্ট্রেশন কাজে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে লেখকদের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় ‘বাধ্যতামূলক’ হয়ে গেছে। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন, সাব-রেজিস্ট্রারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। জেলা সদরের এই সাব-রেজিস্ট্রারের নাম আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি এখানে যোগদান করেছেন ২০২২ সালের ২৭ মার্চ।
এখানে মাসে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ এবং কোনো কোনো মাসে তারও বেশি দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। প্রতিটি দলিলে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য ৭০০ টাকা করে আর জমির মূল্য বেশি হলে নানা সমস্যা আর অজুহাত দেখিয়ে এক লাখ টাকা পর্যন্ত যাবতীয় খরচের সাথে আদায় করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দলিল লেখক জানান, এখানে সর্বপ্রকার কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও বিভিন্ন খাত দেখিয়ে সাহেবের টাকা দিতেই হবে। আর চাহিদা মোতাবেক কোনো ঘাটতি থাকলে বড় অঙ্কের ঘুষ দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। এখানে নিয়ম-অনিয়ম বিষয় নয়, আসল হলো টাকা। নকলের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি পৃষ্ঠাপ্রতি নির্ধারিত থাকলেও তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা নেয়া হয়। কারণ দলিল নকলের জন্য সাব-রেজিস্ট্রার ১০০ টাকা, জেলা রেজিস্ট্রার ১০০ টাকা করে দিতে হয়। এ সুযোগে সংশ্লিষ্ট অন্যদের জন্য আরো যোগ করে একেকটা দলিলের নকলের জন্য দিতে হয় ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।
জেলা শহরের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার এইচ কবির জানান, তার এক আত্মীয় জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে ‘এই লাগবে সেই লাগবে, নচেত কাজ হবে না’ এসব বলার পরও শেষ পর্যন্ত এক লাখ টাকা ঘুষ দিলে কাজ সমাধা হয়। শহরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমিন উল্লাহ জানান, তার দায়িত্বে থাকা একাধিক রেজিস্ট্রেশন কাজে নানা অজুহাত তুলে রেজিস্ট্রি সম্ভব নয় বলে সাব-রেজিস্ট্রারের বরাত দিয়ে লেখক মোহরার জানিয়ে দেন। অগত্যা নির্ধারিত ঘুষের টাকা দিয়েই কাজ সমাধা করতে হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতিও এই সাব-রেজিস্ট্রারের হাত থেকে রেহাই পাননি। তার অফিসের প্রধান সহকারীর মাধ্যমে লেখকের টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মোহরার জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদা মোতাবেক কিছু কাগজপত্র তাৎক্ষণিক দেখাতে না পারলে খুটিনাটি প্রশ্ন তুলে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় নেয়া হয়। এ ছাড়া সেরেস্তা বাবদ প্রতি দলিলে ৩০০ টাকা করে বাধ্যতামূলক দিতে হয়। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ ফান্ড থেকেও অর্ধেক টাকা সাব-রেজিস্ট্রার পান, বাকি অর্ধেক চলে যায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পেটে।
জমি রেজিস্ট্রেশনের নিয়মে আছে- কোনো ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হলে অথবা অতি সম্মানিত ব্যক্তি হলে নির্ধারিত ফিয়ের বিনিময়ে সাব-রেজিস্ট্রার বা তার প্রতিনিধি বাসায় বা হাসপাতালে গিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারেন। এটাকে কমিশনে রেজিস্ট্র্রেশন বলে। এ অফিসে কমিশনে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে বিশাল দুর্নীতি অব্যাহতভাবে চলে আসছে। অতি সম্প্রতি একজন দলিলদাতা ঢাকায় কমিশনে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেন। অজ্ঞাত কারণে রেজিস্ট্রেশনটি না হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ওই টাকা অফিস বা দাতাকে ফেরত দেননি। এ অফিসের একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় কমিশনের জন্য নির্ধারিত ফি ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি নয়।
গত ২৮ মে থেকে কমিশন ফিসহ নানা বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনের সাথে দলিল লেখকদের দর কষাকষি চলছে। সাব-রেজিস্ট্রার তার অবস্থানে অনড়। বরং মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সাব-রেজিস্ট্রার কমিশন রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে রেখেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একজন লেখক জানান, এই সাব-রেজিস্ট্রার প্রায়ই অফিস করেন না, দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে শুনতে পান সাহেব আজ ছুটিতে আছেন। এতে সাধারণের ভোগান্তির শেষ নেই। গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও এ সপ্তাহে বুধবারও তিনি অফিসে নেই। এ ছাড়া তিনি প্রতিদিন অফিসে আসেন দুপুর ১২টার দিকে। মাঝখানে আবার দীর্ঘ বিরতিতে থাকেন। ফলে সংশ্লিষ্ট কাজে আসা লোকজন এর নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়।
তথ্য অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, জেলার সকল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দায়িত্বে থাকা জেলা রেজিস্ট্রারকে সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও চন্দ্রগঞ্জ অফিস থেকে এক লাখ টাকা করে মাসিক হারে এবং রামগতি ও কমলনগর অফিসকে ৫০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হয়।
জানতে চাইলে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘আপনার কোনো সমস্যা হলে সোজা আমার অফিসে এসে ফ্যানের নিচে বসে থাকবেন আপনার যেকোনো কাজ কম টাকায় আমি করে দেবো।’
সাব-রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনের সাথে ৬ মে দুপুরে সাক্ষাৎ করে এ সব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ অফিসে নিয়মের বাইরে কিছু হয় না। এ সবের কোনো সত্যতা নাই। আপনার যেকোনো প্রয়োজনে আমার নিকট চলে আসবেন। প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সেক্রেটারি আমার কাছে প্রায়ই আসেন। আমি তাদের কাজ করে দেই কোনো সমস্যা হয় না।
জেলা রেজিস্ট্রার লোকমান হোসেনের কক্ষে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। অফিসে থাকা অন্যরা জানান তিনি ছুটিতে আছেন।


আরো সংবাদ



premium cement