২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কলাপাড়ায় আবাসন আগ্রাসনে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি অনাবাদি

১০ হাজার একর জমি কৃষকের হাত ছাড়া
কলাপাড়ায় আবাসন প্রকল্পের কারণে অনাবাদি রয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি : নয়া দিগন্ত -

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ও কলাপাড়া এলাকায় অন্তত ১০ হাজার একর কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এসব জমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন স্থায়ীভাবে পতিত পড়ে আছে। এ কারণে প্রতি বছর অন্তত ১৫ হাজার মেট্রিক টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হচ্ছে। গত এক যুগ ধরে চলে আসা এই আবাসন আগ্রাসনের প্রভাবে অনাবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই বেড়েই চলছে।
কুয়াকাটায় প্রতি বছর শুধু তরমুজের আবাদই হতো কয়েক কোটি টাকার। যা এখন হয় না বললেই চলে। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা ছাড়াও এর আশপাশের প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার অধিকাংশ কৃষিজমি এখন কৃষকদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের খাজুরা থেকে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি ও কাউয়ারচর পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকায় কৃষিকাজে ব্যবহৃত আরো অন্তত পাঁচ হাজার একর জমি পতিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকদের মালিকানায় থাকা অন্তত পাঁচ হাজার একর কৃষিজমি এখন এক শ্রেণীর আবাসন ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাচ্ছে। এ কারণে জমি বেচাকেনার দালালদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গেছে এ এলাকায়। যদিও বা উল্লিখিত অর্ধেক জমিতে এখন পর্যন্ত হালচাষ হচ্ছে। কিন্তু মালিকানা পাল্টে গেছে।
জমির মালিকানা বদল প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রায় ২০ বছর আগে থেকে। কিন্তু এসব জমিতে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের স্থাপনা তোলা হয়নি। তবে কুয়াকাটা পৌর এলাকাসহ তার আশেপাশের জমির চারদিকে দেয়াল কিংবা পিলার দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওসব জমিতে হালচাষ। ধানসহ কৃষি উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব এলাকার কৃষকসহ হাইলা-কামলা ও কৃষি শ্রমিকরা হারিয়েছে তাদের কর্মক্ষেত্র।
১১-১২ বছর আগেও এসব এলাকার মানুষ তাদের উৎপাদিত ধানসহ রবিশস্য নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত ফলন বাইরে বিক্রি করত। অথচ বর্তমানে নিজেদের খোরাকির চাল এলাকার বাইরে থেকে কিনতে হয়। তাদেরকে খাদ্য সামগ্রীর জন্য এলাকার বাইরের মোকামের দ্বারস্থ হতে হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, কৃষিনির্ভর এই এলাকার মানুষ এখন কৃষিজমি হারিয়ে কৃষি ফলনে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বর্তমানে চাষাবাদ হচ্ছে এমন জমির উপরেও বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির সাইবোর্ড যত্রতত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
উপজেলার ২০১১ সালের ল্যান্ড জোনিং রিপোর্ট অনুসারে লতাচাপলী ও ধুলাসার ইউনিয়নে মোট জমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ২৭৩ একর। এর মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ১৩ হাজার ৪৪১ একর। বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার অবস্থান লতাচাপলী ইউনিয়নে এবং পর্যটন পল্লী গঙ্গামতির অবস্থান ধুলাসার ইউনিয়নে। লতাচাপলী ইউনিয়নের পশ্চিম খাজুরা গ্রাম থেকে গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫০টি কৃষক ও জেলে পরিবার এখান থেকে বাড়িঘরসহ চাষের জমি বিক্রি করে চলে গেছে অন্যত্র। মাঝিবাড়ি, মিরাবাড়ি, পশ্চিম কুয়াকাটা, কুয়াকাটা, কেরানিপাড়া, নবীনপুর, শরীফপুর, মম্বিপাড়া, হুইচেনপাড়া, বড়হরপাড়া, গঙ্গামতি, ধুলাসার, নতুনপাড়া, কাউয়ারচর, বটতলাসহ আরো অনেক এলাকার অবস্থাও একই রকম। হাজার হাজার একর জমিতে এখন দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইন বোর্ড। এক যুগ আগের দেখা মানুষের কাছে এই এলাকা এখন অপরিচিত বলেই মনে হবে। মাইলের পর মাইল কৃষিজমি যেভাবে অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে, তাতে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরেজমিন না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কী পরিমাণ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি আবাসন প্রকল্পের বিরাট এলাকা দেড় যুগ ধরে অনাবাদি পড়ে আছে। ওই এলাকা থেকে ইতোমধ্যে ওয়াজেদ খান, শামসুল হক, মুনসের, ফজু হাওলাদার, মোসলেম আলী, কালামসহ বহু কৃষক তাদের জমিজমা বিক্রি করে পাশের তালতলীসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। যারা রয়েছেন তারাও আবাসন আগ্রাসনের কারণে চাষাবাদ করতে পারছেন না। এমনি দুই ভুক্তভোগী সুলতান ও এমাদুল জানান, অনেক বছর ধরে তারা নিজেরা তরমুজের আবাদ করতে পারছেন না। এখন নিজ এলাকায় বসবাসও কষ্টকর হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। কারণ নিরাপদ পানির সঙ্কট। দুরের কোন গভীর নলকূপই এখন তাদের নিরাপদ পানির একমাত্র ভরসা। মোট কথা চাষাবাদ তো দূরের কথা, এখন হাজার হাজার কৃষক পরিবারের বসবাসে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কলাপাড়ায় ল্যান্ড জোনিং বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোখলেসুর রহমান স্পষ্ট করে বলেছেন, কুয়াকাটায় আবাসন কোম্পানির ব্যবসায় সরকারিভাবে কোনো ধরনের অনুমতি দেয়া হয়নি। আর কৃষিজমিতে আবাসন ব্যবসার কোনো সুযোগ তো নেই-ই। তার পরও কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা পর্যটন এলাকাসহ সর্বত্র কৃষিজমি কিনে আবাসন প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। সবুজের আস্তরণে ঢাকা সাগরপারের জনপদ পরিণত হতে যাচ্ছে এক বিরান ভূমিতে।
কৃষি কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ জানান, সরকারিভাবে কলাপাড়ায় অন্তত আট হাজার হেক্টর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে হেক্টর প্রতি অন্তত ৪ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হতো। তবে এখন জমি কমলেও কৃষকরা উন্নত জাতের ধানের আবাদ করে ফলন বাড়িয়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল