২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সরকারি কর্মকর্তা ও দালাল সিন্ডিকেট মিলে লুটপাট

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (বাঁয়ে) ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে বিপুল জমি : নয়া দিগন্ত -

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বড় বড় প্রকল্প ঘিরে অধিগ্রহণ করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের জমি আর ভিটা। তবে এ অধিগ্রহণ নিয়ে কয়েক বছর ধরেই চলছে বিশৃঙ্খলা। ক্ষতিপূরণ পেতে দেরি, অনিশ্চয়তা ছাড়াও আছে দালাল ও একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের উৎপাত। দালালের সহায়তায় অনেক প্রকৃত জমির মালিকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেয়া হয়েছে মামলা। এতে মিলছে না ক্ষতিপূরণ, ঠাঁই হচ্ছে না পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে বহু পরিবার। আবার অনেককে পুনর্বাসন করা হলেও তাদের আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের জীবন চলছে খুব কষ্টে। কলাপাড়ায় মেগা প্রকল্পের কারণে ইলিশ প্রজননসহ প্রাণ-প্রকৃতিরও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য ৬ হাজার ৫৬২.২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ হাজার ২০০ পরিবার। পুনর্বাসনের তালিকায় এসেছে ৩ হাজার ৪২৩ পরিবার। পুনর্বাসিত হয়েছে ১ হাজার ৫০০-এর মতো পরিবার। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলমান। পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৯৮২.৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ১৩০ পরিবারই পুনর্বাসনের তালিকায় এসেছে। এখনো ঘর হস্তান্তর হয়নি।

পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পাওয়ার স্টেশনের (আরএনপিএল) নির্মাণকাজ চলছে। এ স্টেশনের জন্য ৯১৫.৭৪ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এখানে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ২৮১ পরিবারকেই পুনর্বাসনের তালিকায় আনা হয়েছে। পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৬ হাজার ৭০০ পরিবার। তাদের পুনর্বাসনের কাজ চলছে। পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপারথার্মাল পাওয়ার প্লান্ট (আশুগঞ্জ) নির্মাণের জন্য ৯২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ১৮০ পরিবারকেই পুনর্বাসনের তালিকায় আনা হয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

বিএনএস শেরেবাংলা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বৃহত্তম নৌঘাঁটি নির্মাণে ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছাড়াও আরো ৬২০ একর জমির অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান। এ এলাকায় কত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে তথ্য পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বেশি জমি অধিগ্রহণ হয়েছে কলাপাড়ার লালুয়া ও ধানখালী ইউনিয়নে। এ দুই ইউনিয়নের ২১ গ্রাম এখন জনবসতি শূন্য।
ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে কলাপাড়ায় দালাল চক্র ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসনের কয়েজন কর্মকর্তাকে হাত করে চালাচ্ছে সব অনৈতিক কর্মকান্ড। এর সত্যতা মিলেছে পটুয়াখালীর নতুন জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলামের সাথে স্থানীয় সুধীজনের এক মতবিনিময় সভায়। গত ১৩ ডিসেম্বর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদ হলরুমে অনুষ্ঠিত এ সভায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য তুলে এর প্রতিকার চাওয়া হয়।

অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে কারা জড়িত- এমন প্রশ্নে এক জনপ্রতিনিধি বলেন, সব গ্রামের শত শত দালাল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সাথে যোগাযোগ রেখে নানা তথ্য সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকের বিরুদ্ধে ওয়ারিশ দাবি করে মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়। একই জমির একাধিক ব্যক্তিমালিকানা দাবি করে অধিগ্রহণ শাখায় অনাপত্তি কিংবা মামলা করার পর পুরো কার্যক্রমটি স্থবির করে দেয়। এ কারণে মালিকানা চিহ্নিত হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া হয় না।
ক্ষতিগ্রস্ত হালিম মাঝির স্ত্রী চম্পা জানান, তিনি ৪৫ শতাংশ জমিতে ঘরবাড়ি তুলে বাস করছিলেন। ঘরের ক্ষতিপূরণ না দিলেও বাড়ির গাছপালা ও পুকুরের জন্য ৬ লাখ টাকা পেয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই না হওয়ায় ৬ শতাংশ জমি কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়েছেন।

ধানখালীর গোলাম মাওলার স্ত্রী সালমা বেগম জানান, ৪০ বছর ধরে তারা বাস করছেন এখানে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তাদের ১২ কাঠার বসতভিটা ও কৃষিজমির পুরোটাই দিয়ে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৭ লাখ টাকা। এ থেকে দালাল আজিজুর রহমানকে দিতে হয়েছে ৩ লাখ টাকা। তারা এখন উঠেছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রে। স্থানীয় আবুল বাশার জানান, অধিগ্রহণের সময় তার ১৬ লাখ টাকার ঘরের দাম ধরা হয় ৬ লাখ টাকা। কৃষিজমিসহ ১৮ লাখ টাকা তুলতে আতাউল্লাহ নামে এক দালালকে দিয়েছেন সাড়ে ৫ লাখ টাকা।

ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় টাকা ছাড়া কোনো নথি নড়ে না। লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামের হানিফ হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, ঘরের ক্ষতিপূরণের ৯ লাখ টাকা তুলতে দালাল ও এলএ কর্মকর্তাদের প্রতি লাখে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছি। এলএ শাখা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

এদিকে কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নে পায়রা সমুদ্রবন্দরের ভূমি অধিগ্রহণের মামলা জটিলতায় ২১৪ পরিবার স্থায়ী সম্পত্তি ও পৈতৃক বসতবাড়ি হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ পরিবার বেড়িবাঁধে খুপরি ঘরে বাস করছে। অধিগ্রহণে সব হারানো চান মিয়া, আকবর ফকির, মোসারেফ হাওলাদার জানান, দালাল চক্র মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের টাকা আটকে রেখেছে।

কলাপাড়া পরিবেশ ও জনপরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক লালুয়া ইউনিয়নের শাহাদাত হোসেন বিশ্বাস বলেন, এ এলাকায় বহু মানুষ মামলার ফাঁদে পড়ে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। তারা উচ্ছেদ হলেও পাননি পুনর্বাসন। এ ব্যাপারে পটুয়াখালী সহকারী কমিশনার (ভূমি অধিগ্রহণ শাখা-১) আবদুল কাইয়ূম বলেন, মামলা চলমান থাকলে আমরা অধিগ্রহণের টাকা দিতে পারি না।
বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরামের সমন্বয়কারী শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, প্রকল্প ঘিরে জাহাজ চলাচল বেড়ে যাওয়ায় নদীগুলোতে পড়ছে গরম পানি ও বর্জ্য। ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক ছোট ছোট খাল ও জলাশয়। কমেছে কৃষিজমিও।


আরো সংবাদ



premium cement