২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মরে যাচ্ছে শিববাড়িয়া : জেলেরা হারাচ্ছেন পোতাশ্রয়

-

এক সময় জোয়ার ভাটার কুলকুল ¯্রােতে বয়ে যাওয়া নদীটি এখন একটি ছোট্ট খাল। সে সময় এপাড় থেকে ওপাড় সাঁতার কেটে যেতে ভয় হতো। এখন এপাড় থেকে ওপাড়ে ঢিল ছুড়তে পারে কিশোররাও। এটি মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুর বাজারের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শিববাড়িয়া নদী। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দিন দিন মরে যাচ্ছে নদীটি। নদীটি নিয়ে নেই কারো মাথাব্যথা। কেউ নিচ্ছে না খননের উদ্যোগ। ফলে এ অঞ্চলের মৎস্যজীবী, মাছ ব্যবসায়ীসহ সবার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, শিববাড়িয়া (খাপড়াভাঙ্গা) নদীর পানি প্রবাহের দৈর্ঘ্য ১৭ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৩৩০ মিটার। এই নদীর গভীরতা ১৫ মিটার। এখন প্রতি বছর অন্তত পাঁচ ফুট কমে যাচ্ছে নদীর প্রস্থ। একশ্রেণীর প্রভাবশালীর কারণে নদীর দুই পাড়সহ তীরবর্তী এলাকা যেমন ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে নদীর তলদেশ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, শিববাড়িয়া (খাপড়াভাঙ্গা) নদীটি পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর মোহনার আন্ধারমানিক নদের প্রবেশদ্বার থেকে পূর্বদিকে কাউয়ারচরের আশাখালী পয়েন্ট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে নাইওরীপাড়া, গোড়া আমখোলা পাড়া, লক্ষ্মীরবাজার, চাপলীবাজার, মহিপুর ও আলীপুর অংশে নাব্যতা সঙ্কট সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে। আলীপুর ও মহিপুর পয়েন্টের নদীতীরবর্তী এলাকা একশ্রেণীর লোকজন দখল করে আধা পাকা ও পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। যে কারণে মাছ ধরা নৌকা, ট্রলারসহ নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া নদীটির আন্ধারমানিক ও আশাখালীর দুই প্রবেশদ্বারও ৯০ শতাংশের মতো ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে জোয়ারের সময় পুরো নদী ধরে জেলেরা চলাচল করতে পারলেও ভাটার সময় আর চলাচল করতে পারে না। অথচ এই নদীটি ছিল ষাটের দশকেরও আগে থেকে উপকূলের মানুষের চলাচলের একমাত্র পথ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে প্রচণ্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকার বালু ক্ষয়ে নদীর প্রবেশমুখে চর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিববাড়িয়া নদীতে জোয়ার-ভাটার ¯্রােত কমে যাচ্ছে। ¯্রােত কমে যাওয়ার জন্যই নদীটির তলদেশ আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
কেউ কেউ মনে করছেন নদীর দুই তীরে ট্রলার মালিকদের নোঙর করে রাখা অকেজো পুরনো ট্রলারের বডি, বর্ষা মৌসুমে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোর্ড ব্যবসায়ীদের রাখা ট্রলার, মৎস্য ব্যবসায়ীদের গদিতে মাছ ওঠানোর জেটি, বরফকল মালিকদের বরফ নামানোর জেটি, জেটির পাড়ে নদীর তীরের নির্মিত রাস্তা, নদীর পাড়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের রাখা বাঁশ, নদীতে নির্মাণাধীন শেখ রাসেল সেতুর পিলার ও অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার জন্য ¯্রােত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পলি পড়ে নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খনন করা হলে কিছুটা হলেও নদীতে বৃদ্ধি পাবে ¯্রােত। কিন্তু নদীটি কবে নাগাদ খনন করা হবে তার কোনো সঠিক জবাব দিতে পারেনি পাউবো কর্তৃপক্ষ।
উপকূলের মৎস্যজীবী জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে ফিরে আসেন নদীটিতে। দুর্যোগকালে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল এ নদী। সমুদ্রঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে কয়েক হাজার মাছ ধরার ট্রলার এ নদীতে এসে নিরাপদে নোঙর করে। তাই শিববাড়িয়া নদীটি উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দূর-দূরান্তের জেলেদের কাছে পোতাশ্রয় হিসেবে পরিচিত। নদীটির দু’পাড় থেকে প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার মাছ দেশ-বিদেশে যাচ্ছে। এজন্যই আলীপুর-মহিপুর মৎস্য বন্দর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এ নদীটি পুরোপুরি মরে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মৎস্যজীবী জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ার সঙ্কেত পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে জেলেরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে না। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা পড়বেন বিপাকে। মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটার ব্যবসায়ীরা পারবেন না নৌপথে খুলনা, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল থেকে মালামাল আনতে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিঙ্কন বায়েন বলেন, নদীটি ভরাট হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মহীপুর-আলীপুর বন্দরটি। বিপাকে পড়বেন উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপর। তিনি আরো বলেন, গ্রামগঞ্জের ফসলি জমির বৃষ্টির পানি ছোট ছোট খাল থেকে শিববাড়িয়া নদী হয়ে সমুদ্রে নেমে যায়। নদীটি ভরাট হয়ে গেলে ওই অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন বলেন, বিষয়টি সার্ভে করে পাঠাতে বলেছে মন্ত্রণালয়। মাপজোখ হয়েছে। এখন আমরা পাঠিয়ে দিবো।

 


আরো সংবাদ



premium cement