২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভোলার ৫০ হাজার নৌযান শ্রমিকের মানবেতর জীবন

লকডাউনে বন্ধ নৌযান চলাচল
-

করোনার প্রভাবে চলমান লকডাউনে স্থবির হয়ে পড়েছে ভোলা-ঢাকা তথা দক্ষিণাঞ্চলগামী নৌযান চলাচল। বন্ধ রয়েছে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। ফলে নৌযানের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিক ও ঘাটসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন বিপাকে। এই দুর্দিনে মালিকপক্ষ কিংবা শ্রমিক সংগঠন কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না তারা। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে মানবেতর দিন কাটছে লঞ্চের সাথে জড়িত শ্রমিকদের। বেশির ভাগ শ্রমিকই পাননি সরকারের সহায়তাও। লঞ্চ মালিকদের দাবি, দিনের পর দিন লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না তারা। যদিও জেলা প্রশাসক বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত নৌ শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ উপহার।
দ্বীপ জেলা ভোলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য রুটে যোগাযোগের অন্যতম সহজ মাধ্যম নৌপথ। প্রতিদিন নৌপথে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ লঞ্চে করে ভোলায় যাতায়াত করে থাকে। আবার ভোলা থেকে হাজার হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশাল কিংবা লক্ষ্মীপুর হয়ে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে। আর ঈদ মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ লঞ্চে করে বাড়ি ফিরে থাকেন। এ জেলার একটি বড় জনগোষ্ঠীর জীবিকা চলে লঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজে। লঞ্চ শ্রমিক, কুলি, ঘাট ব্যবসায়ী ও ঘাটের ইজারাদার নানা পেশায় থেকে তারা জীবিকার ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে করোনা পরিস্থিতিতে সব লঞ্চ বন্ধ থাকায় ঘাটগুলোতে নেই কর্মচাঞ্চল্য। বন্ধ রয়েছে সব ধরনের নৌযান চলাচল। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় নৌ-সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটছে তাদের। এ দুর্দিনে মালিকপক্ষ কিংবা শ্রমিক সংগঠন কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না তারা। পাচ্ছেন না সরকারের কোনো সহায়তাও।
ভোলার মেসার্স ব্রাদার্স নেভিগেশন কোম্পানির লঞ্চ কর্ণফুলী-১১-এর স্টাফ আবু সাঈদ বলেন, আমরা যার লঞ্চ স্টাফ বা লঞ্চের মালিক তারা দু’টি ঈদের আশায় থাকি। এ সময় অনেক যাত্রী লঞ্চে করে যাতায়াত করে থাকেন। সিট ভাড়া দিয়ে বা কাজ করে যাত্রীদের কাছ থেকে টিপস পাই। আবার মালিক ঈদ উপলক্ষে কিছু টাকা বোনাস দিয়ে থাকেন। তাই দিয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করি। কিন্তু গত বছর করোনার কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল এবং এ বছরও একই অবস্থা। তাহলে আমরা স্টাফ বা লঞ্চ শ্রমিকরা কিভাবে চলব। যেই বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টকর। লঞ্চ বন্ধ থাকায় মালিকরাও লসে আছেন। তাহলে আমাদের বেতন দেবেন কিভাবে আর বোনাসই বা দেবেন কিভাবে। সরকার যদি ঈদের কয়েক দিন আগে এই রুটের লঞ্চগুলো চালু করে দেয় তাহলে যাত্রীদের উপকার হবে। আমাদের লঞ্চ মালিক-স্টাফদেরও উপকার হবে।
এমভি ভোলা লঞ্চের স্টাফ আব্দুল মান্নান বলেন, করোনার কারণে আমাদের লঞ্চ চলাচল বন্ধ। লঞ্চের মালিক ঠিকমতো বেতন দিতে পারেন না। খাওয়াদাওয়ায় অসুবিধা। সামনে ঈদ। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। সরকারি কোনো সহযোগিতা আমরা পাচ্ছিনা। শুনছি প্রধানমন্ত্রী ঈদ উপহার হিসেবে শ্রমিকদের ২৫০০ টাকা করে দিয়েছেন; কিন্তু আমরা সেই টাকা পাইনি। সরকার বলছে ত্রাণ সবার ঘরে পৌঁছে দেবে; কিন্তু আমরা কোনো ত্রাণ পাইনি। চেয়ারম্যান-মেম্বার কোথাও ত্রাণ পৌঁছান না।
একই লঞ্চের কোয়ার্টার মাস্টার নুর উদ্দিন বলেন, লঞ্চ চললে আমাদের সংসার চলে, লঞ্চ না চললে চলে না। সামনে ঈদ, এ সময় পোলা-মাইয়ারে কিছু কিনা দিমু তাও সম্ভব হচ্ছে না।
ভোলার নিউ শপিং কর্নারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জিতু বলেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সমস্য হচ্ছে। সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুলে দেয়ায় দোকানে জামাকাপড় কেনার চাহিদা বাড়ছে; কিন্তু রাজধানী থেকে মালামাল আনার ইচ্ছা থাকলেও আনতে পারছি না। স্থলপথে খরচ বেশি লাগায় মালামাল এনে পোষায় না। আমাদের জন্য লঞ্চে মালামাল আনানেয়া করা সবচেয়ে সহজ।
শুধু নৌ শ্রমিকরাই নন ঘাটে থাকা দোকান ও হোটেল ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। খেয়াঘাট এলাকার দোকানদার মাকসুদ জানান, লঞ্চ চলাচলের ওপর আমাদের ব্যবসা অনেকটা নির্ভরশীল। লঞ্চ চললে ব্যবসা ভালো। লঞ্চ না চললে লোকসান। করোনার কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের দোকানের পণ্য বেচাকেনা কমে গেছে। অনেক পণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন সরকার থেকে যদি তাদের প্রণোদনা দিত তাহলে অনেক উপকার হতো।
ভোলা ইলিশা ঘাটের ইজারাদার সরোয়ারদি মাস্টার জানান, লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের ঘাট ইজারাদারদের অনেক লোকসান হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে অনেক যাত্রী আসতো লঞ্চঘাটে। আমারা ঘাটের টোল আদায় করতে পারতাম; কিন্তু তাও পারছি না। আমরা যারা ঘাটের ইজারাদার করোনার কারণে আমাদের বড় লোকসান গুনতে হচ্ছে। লঞ্চঘাটে শ্রমিকরা মালামাল উঠিয়ে নামিয়ে অর্থ উপার্জন করতো। এখন তারাও অলস সময় বসে আছে।
মেসার্স ব্রাদার্স নেভিগেশন কোম্পানির লঞ্চ মালিক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, লঞ্চ ব্যবসা বন্ধ থাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শ্রমিকদের ঠিক মতো বেতন দিতে পারছি না। এ অবস্থায় শ্রমিকদের সরকারি সহায়তার দেয়ার দাবি করেন তিনি।
ভোলা জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, করোনার লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত নৌ শ্রমিক থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত সব শ্রমিকের কাছে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার পৌঁছে দেয়া চেষ্টা করব।
ভোলা জেলার ২৩টি ঘাট থেকে ছোট বড় প্রায় ৪৬টি লঞ্চ প্রতিদিন ঢাকা রুটে চলাচল করে থাকে। এতে ঘাটে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের।


আরো সংবাদ



premium cement