২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অস্তিত্ব সঙ্কটে উত্তরের ৪৬ নদী

-

পলি ও আবর্জনায় উত্তরাঞ্চলের ৪৬টি নদ-নদী ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে। আবহাওয়ায় বিরাজ করছে মরুর মতো রুক্ষতা। সঙ্কুচিত হয়ে গেছে নৌপথ। ব্যবসা নেই নৌযানের। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। হস্তপালিত নলকূপে পানি উঠছে না। দুঃসহ গরম, প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ে যাচ্ছে ক্ষেত। পশুপাখির প্রাণ ওষ্ঠাগত। পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোও স্বয়ংক্রিয় পরিশোধন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে পানি প্রবাহের মাত্রা ৪০ হাজার ঘনফুট হলে তাতে আর পলি জমতে পারে না। স্রোত নেই বলেই তো পলি জমছে। ১৪টি শাখা নদী ও ৩২টি উপনদী এই মোট ৪৬টি নদ-নদী অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে ১৭টি। এগুলো হচ্ছে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ সীমান্তে গঙ্গা, পাগলা, দিনাজপুর ও নওগাঁয় আত্রাই, পুনর্ভবা ও তেঁতুলিয়া। ঠাকুরগাঁওয়ে কুলিক বা কোকিলা, পঞ্চগড় ও নবাবগঞ্জে মহানন্দা, করতোয়া ও তলমা। নীলফামারী জেলায় ঘোড়ামারা, দিওনাই যমুনেশ্বরী, বুড়িতিস্তা ও তিস্তা। কুড়িগ্রামে দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও জিঞ্জিরাম। লালমনিরহাটে জলঢাকা ও দুধকুমার। জনপদ রচনায় ও ইতিহাসের উপাদান হয়ে আছে এ সকল নদ-নদী।
উত্তরের ১৬ জেলায় ভূখণ্ড নির্ণয় ও সমৃদ্ধ করেছে নদ-নদী। এক ইছামতি নদী রয়েছে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায়। নদীর পানিই বাঁচিয়ে রাখে জীবন। নদীর পানি পরিবেশের প্রধান উপাদান। যা মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গসহ সকল জীবকে লালন করে। মাটি ও মানুষকে করে সজীব। সামাজিক জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সভ্যতা সংস্কৃতিতে নদ-নদীর প্রভাব অপরিসীম। পদ্মা নদীর বদৌলতে ইছামতি নদী তীরে গড়ে উঠেছিল পাবনা বন্দর। নদী, নৌপথ আর নৌযানকে ঘিরেই এ অঞ্চল হয়ে উঠেছিল ব্যবসা প্রধান। পদ্মা ও যমুনা সৃষ্টি করেছে এই জনপদ। উর্বর করেছে মাটি। মূলত এ দু’টি নদীই দিয়েছে শক্তি। বাড়িয়েছে সবুজের সমাহার। জেলেকে করেছে সমৃদ্ধ।
বৈজ্ঞানিক দিক থেকে পানি ও বাতাসের সাথে মানুষের রক্তের নিবিড় সম্পর্ক। এ অঞ্চলে রয়েছে পলিমাটির প্রলেপ দেয়া বিশাল সমতল ভূমি। ষাটের দশক থেকে নদীসমূহে ক্রমাগত পলি ও আবর্জনা পড়ে তলদেশ ভারা হয়ে ওঠায় নৌপথ কমে গেছে। নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘœ ঘটছে।
উত্তরাঞ্চলের নদী অববাহিকায় স্বর্ণাভ মাটিতে ফলে বাদাম, সোনালি আঁশ, আখ, ধান, গম, সরিষা, কালাই প্রভৃতি। উপনদী মহানন্দা, নাগর, টাংগন ৩৬ কিলোমিটার প্রস্থের এ নদী ভোলাহাট থেকে গোদাগাড়ী পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন এসব নদীর অস্তিত্ব হুমকীর মুখে। ১৭৮৭ সালের বন্যায় তিস্তা নদী পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মিলিত হয় ব্রহ্মপুত্রের সাথে। এতে নাগর, পনর্ভবা, মহানন্দা আত্রাই প্রভৃতি নদীর প্রবাহ কমে যায়। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে পাবনার চাটমোহরের করতোয়া নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নদী রেখা মুছে যায়। নানা কারণে উত্তরের নদীসমূহ বালুচরে পরিণত হওয়ায় আবহাওয়ায় মরু রুক্ষতা বিরাজ করছে।
সেচ ব্যবস্থা গভীর নলকূপ নির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলের হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। সুপেয় খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দুঃসহ গরম, প্রচণ্ড তাপদাহে ক্ষেতে পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন, মানুষ ও পশুপাখির প্রাণ ওষ্ঠাগত।
পাবনা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে পদ্মা, পূর্বে যমুনা, উত্তরে বড়াল এবং হুড়াসাগর নদী। জেলার মানচিত্র অনেকটা ত্রিভূজ আকারের। এ নদীসমূহের কল্যাণে নির্ধারিত হয়েছে এ জনপদের সীমারেখা। এ জেলায় ২০টি নদীর মধ্যে আরো রয়েছে ভাঙ্গুড়ার ইছামতি, বেড়ার হুড়াসাগর, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, চাটমোহরের বড়াল, করতোয়া, গুমানী, ফরিদপুরের গোহালা, জলকা, খলিশাডাঙ্গী, শালিকা, আটঘড়িয়ার চিকনাই, চন্দ্রবতী, রতœাই, কমলা, ঈশ্বরদীর ট্যাপাগাড়ী, সুজানগরের বারনাই, বাদাল, সাঁথিয়ার আত্রাই ও পাবনার ইছামতি।
রাজশাহী জেলার প্রধান নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে, পদ্মা (গঙ্গ), মহানন্দা, বড়াল, বারনাই, শিব ও ফকিরনী। রংপুরের তিস্তা, আলাইকুসারী, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী, আখিরা, চিকলী, চিলমারী।
দিনাজপুরের ভূগোল ১৯টি নদীর মধ্যে নানা কারণে প্রায় মুছে গেছে তিলাই, মাহিলা, বেলান, ভেলামতি, গর্ভেশ্বরী, চিরির এবং সোয়া। আংশিক রয়ে গেছে তুলসীগঙ্গা, পাথরাজ, ইছামতি, কাঁকড়া ও টাঙ্গন। দিনাজপুরের ঢেপা, পুনর্ভবা, কাঞ্চন, যমুনা, আত্রাই, খরখরিয়া, তুলসীগঙ্গা, ইছামতি, চামতি, সবগাড়ী, ও ভাদই। রুগ্ণœ হয়ে পড়েছে বরেন্দ্র ভূমির মধ্য অংশকে পূর্ব ও পশ্চিম দু’ভাগে করে ্রবাহিত আত্রাই নদী। মান্দা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আত্রাই পড়েছে চলনবিলে। আরো রয়েছে নাটোরের নন্দকুজা, নারদ, আদাম দীঘির ইরামতি, স্বর্ণমতি, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ক্ষীণধারার করতোয়া, জয়পুরহাটে ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, হারাবতি ও ছিরি। লালমনিরহাটে জলঢাকা, ধরলা, নীলফামারির বুড়িতিস্তা, চিকি বুল্লাই, চিকনী, খড়খড়ি, ও যমুনেশ্বরী। একই নদী কয়েকটি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
নদী খনন না করায় নওগাঁ জেলার ১০টি নদী নব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এগুলো হচ্ছে- আত্রাই, ছোট যমুনা, পুনর্ভবা, শিব, ফকিরনী, নলামারা, গুরনই, নাগর, চিরি ও তুলসীগঙ্গা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। এ দেশের কৃষি সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বানিজ্য, পরিবেশ- এর সবই নদীনির্ভর। অর্থাৎ নদীকে বাদ দিয়ে এদেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন-জীবিকা কল্পনাই করা যায় না। দ্রুত নদীগুলো খনন করে নব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে, অন্যথায় নদীগুলো চিরতরে হরিয়ে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement