২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বৃক্ষপ্রেমীর সবুজ বিপ্লব

-

ছায়া-সুনিবিড় পাখি ডাকা গ্রাম মানিকগঞ্জ হরিরামপুরের কৌড়ি গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রাশি রাশি বৃক্ষ। গাঁয়ের আঁকাবাঁকা পথের দু’পাশে ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষে পূর্ণ সবুজের সমাহার। নয়নাভিরাম এই সবুজ বিপ্লবের নায়ক কৌড়ি গ্রামেরই সন্তান শাহজাহান বিশ্বাস।
শাহজাহান বিশ্বাসের শখ গাছ লাগানো। গাছের সাথেই যেন তার সব সখ্য। গাছই যেন সংসার। এলাকায় তিনি ‘গাছ শাহজাহান’ নামেই পরিচিত।
বৃক্ষের প্রতি সখ্য শুরু ১৯৭৯ সালের দিকে। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সড়ক, খালেরপাড়, গ্রামের কাঁচা পথের দু’ধারে বনায়ন ও স্বেচ্ছায় গোরস্থান, শ্মশান, বাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এবং অন্যের পতিত জমিতে ৭০ হাজারের অধিক গাছের চারা রোপণ করছেন। শুধু চারা রোপণ করেই তার কাজের সমাপ্তি হয় না। চারা পরিচর্যা, পানি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, বেড়া দেয়া থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ তিন যুগেরও অধিক সময়ে নিয়মিতভাবেই করে যাচ্ছেন অতি যতেœর সাথে।
সুন্দর পরিবেশ রক্ষায় মানিকগঞ্জের এই বৃক্ষপ্রেমিক ‘শাহজাহান বিশ্বাস’ তার নিজ কর্মগুণে হয়ে উঠেছেন অন্যন্য, পেয়েছেন খ্যাতি আর মানুষের ভালোবাসা। সরেজমিন ঝিটকার কৌড়িতে গিয়ে দেখা গেছেÑ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও মসজিদসহ রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন প্রকারের গাছ রোপণ করছেন তিনি। তার দেখাদেখি কৌড়িসহ আশপাশের গ্রামের প্রায় সবাই তাদের বাড়ির আঙিনায় গাছ রোপণ করছেন।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি এলাকার মৃত ওবায়দুদ বিশ্বাসের ছোট ছেলে ৬২ বছর বয়সী শাহজাহান বিশ্বাস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করেন এই লড়াকু সৈনিক। এরপর ১৯৭৬ সালে ভ্রমণের জন্য চলে যান দেশের বাইরে সিংগাপুর ও মালয়েশিয়া। এরপর দীর্ঘ দিন বিদেশ ভ্রমণ শেষে ১৯৭৯ সালে আবার চলে আসেন নিজ গ্রাম কৌড়িতে। এসে শুরু করেন গাছ রোপণ। প্রথম দিকে কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয় তাকে। শুরুর দিকে শাহজাহানের পরিবার ও সমাজের কেউ ভালোভাবে নেয়নি এ কাজটি। তবুও থেমে যাননি গাছপ্রেমী শাহজাহান। আজও তিনি নিঃস্বার্থভাবে একের পর এক গাছ রোপণ করছেন। এ পর্যন্ত ৭০ হাজারের অধিক গাছ রোপণ করেছেন তিনি। তার দেখানো পথে এলাকার মানুষ ২০ লক্ষাধিক গাছ রোপণ করেছে।
গ্রামজুড়ে রাস্তার দু’পাশে লাগানো গাছের কারণে মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলার মানুষের কাছে এ স্থানটি দর্শনীয় হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। চলচ্চিত্র পরিচালক ও টিভি নাট্যকাররা তাদের চলচ্চিত্র ও নাটকের বেশির ভাগ শুটিং করতে আসছেন এই সবুজ গ্রামে। এই গ্রামের সোন্দর্যবর্ধনের জন্য সেগুন, মেহগনি, আকাশমনি, নিম, হরীতকী ও কাঠবাদামসহ বিভিন্ন প্রকারের বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে কৌড়ি গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে।
সোনাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুলের মাঠে খেলতে নামতে পারতাম না রোদের কারণে। শাহজাহান ভাই নিজ উদ্যোগে স্কুলের চার পাশে বিভিন্ন প্রকার গাছ রোপণের কারণে ছায়া পড়ছে স্কুল মাঠে। ফলে স্কুলের শিশুরা ছায়ার মধ্যে খেলাধুলা করতে পারছে।
এম এ রউফ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, তার গাছ রোপণের ফলে গ্রামের যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন তা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে।
বৃক্ষপ্রেমিক শাহজাহান বলেন, উদ্ভিদ আর প্রাণী এমনভাবে জড়িত এক ছাড়া অন্য নিরুপায়। মানুষ তো প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ উদ্ভিদ প্রয়োজন, সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তা হলে তো এই দেশ একসময় মরুভূমি হয়ে যাবে। তাই আমি আমার ব্যক্তি চেষ্টায় আমার আশপাশের পরিবেশ সাজিয়েছি। আপনারা সবাই নিজ নিজ বাড়ি ও গ্রামে সবুজ পরিবেশ গড়ে তুলুন।
বন কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, শাহজাহান বিশ্বাসের গাছ লাগানোর এমন খবরটি আমরা জানতে পেরেছি। তার এই মহৎ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। শাহজাহানের মতো দেশের মানুষ এভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী গাছ রোপণ করতেন, তা হলে সবুজে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের তেমন সময় লাগত না। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য শাহজাহান বিশ্বাসের এমন মহৎ কাজের কথা সরকারকে জানানো হবে। এ কাজ আরো গতিশীল করতে শাহজাহান বিশ্বাসকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন এই বন কর্মকর্তা।


আরো সংবাদ



premium cement