নানা সঙ্কটে ধ্বংসের মুখে রাখাইন তাঁতশিল্প
- এইচ এম হুমায়ুন কবির কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
- ২১ জানুয়ারি ২০২১, ০২:১২
ব্যাপক সম্ভাবনা সত্ত্বেও নানা সঙ্কটে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প আজ বিপন্ন। রাখাইন নারীদের নিপুণ শৈলীতে তৈরি তাঁতবস্ত্রের দেশব্যাপী সুখ্যাতি ও চাহিদা থাকলেও এর সুফল পাচ্ছেন না এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তাঁতিরা। যে কারণে এখন মানবেতর জীবন কাটছে রাখাইন তাঁতশিল্পীদের।
বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি জাতি রাখাইন। আর্য বংশোদ্ভূত রাখাইনদের প্রাচীন বাসস্থান ছিল মগধ রাজ্য। পরে সেখান থেকে আরাকানে এসে তারা বসতি স্থাপন করেন। পরিচিতি পায় মগধি বা মগ নামে। আড়াই শ’ বছর আগে মিয়ানমারের আরাকান এলাকা থেকে এসে বরগুনা জেলার তালতলী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালীতে বসতি গড়ে তোলে তারা। ১৯০০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ১৬৮টি পাড়ায় পাঁচ হাজার ১৯০টি বাড়িতে প্রায় ৩৫ হাজার রাখাইন ছিল। কলাপাড়া উপজেলায় ১৯৭০-৭১ সালের জরিপ অনুযায়ী রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার আর পাড়ার সংখ্যা ছিল ২৮টি। বর্তমানে কলাপাড়াÑরাঙ্গাবালীতে প্রায় দুই হাজার রাখাইন বসবাস করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরম দুঃসময় পার করছে এক সময়ের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা রাখাইন নারীদের হাতের নিপুণ শৈলীতে তৈরি তাঁতবস্ত্র। এক সময়ে দম ফেলার ফুরসত ছিল না রাখাইন পল্লীতে। দিন-রাত তাঁতের খটখট শব্দে মুখর ছিল কেরানিপাড়া, মিশ্রিপাাড়া, কালাচানপাড়া, আমখোলাপাড়া, দিয়ারআমখোলাপাড়া, বৌলতলীপাড়া, বেতকাটাপাড়া, পক্ষিয়াপাড়া, সোনাপাড়া, বালীয়াতলীপাড়া, থঞ্জুপাড়া, লক্ষ্মীপাড়া, মেলাপাড়া, মংথয়পাড়া, নাইউরীপাড়াসহ রাখাইনদের প্রতিটি পাড়া। রাখাইন পল্লীগুলোতে ঢুকলেই শোনা যেতো তাঁতের টাকুর-টুকুর শব্দ। দেখা যেত রাখাইন নারীদের ব্যস্ততা। এখন আর সেই ব্যস্ততা নেই পাড়াগুলোতে। আর্থিক সঙ্কটে মুষড়ে পড়েছেন তাঁতশিল্পীরা।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামাল ও উপকরণের দামবৃদ্ধি, বাজার সঙ্কট, আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতের বিপরীতে সক্ষমতার ঘাটতি, বিপণন ব্যর্থতা, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব ও পুঁজিসঙ্কটে বন্ধের উপক্রম সম্ভাবনাময় এই শিল্প। এসব কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাখাইনদের তাঁতশিল্পগুলো। রাখাইন নারীরাই মূলত এ পেশার প্রাণ। আর্থিক সঙ্কটে অনেকে এখন পেশা বদল করার চিন্তা করছেন। কেউ কেউ আবার পরিবারের অন্য ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।
সনাতনী পদ্ধতিতে রাখাইন নারীদের হাতে বোনা লুঙ্গি, তোয়ালে, চাদর, জামাসহ নানা সামগ্রীর দাম তুলনামূলক কিছুটা বেশি হলেও টেকে অনেক দিন। কিন্তু সুতার মূল্যবৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও তাঁতশিল্পীদের আর্থিক দৈন্যতা এ পেশাকে করে তুলেছে সঙ্কটময়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মিশ্রিপাড়ায় তাঁত কারখানায় কাজ করছেন একজন মাত্র রাখাইন নারী। একটি তাঁতে কাজ করছেন তিনি। অলস পড়ে আছে আরো কয়েকটি তাঁত। সেখানে কথা হয় মামাসে রাখাইন নামের ওই নারীর সাথে। তিনি জানান, অর্থনৈতিক সঙ্কট, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা আগের মতো তাঁতের কাপড় না কেনায় তাদের খুব দুর্দিন যাচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে অনীহা দেখা দিয়েছে তাঁত কারিগরদের মধ্যে।
এ পাড়ার আরেক বয়স্ক নারী খেনকে রাখাইন বলেন, আগে এক বান্ডিল সুতা কিনতাম ৩৫০ টাকায়, এখন সেই সুতা ৪০০ টাকা। নিত্যনতুন ডিজাইনও করতে পারি না প্রশিক্ষণের অভাবে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো বস্ত্র তৈরি হয় না। এভাবে চলতে থাকলে রাখাইনদের তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।
দিয়ার আমখোলাপাড়ার তাঁতশিল্পী মুমু আক্ষেপ করে বলেন, এক কেজি সুতায় দু’টি গায়ের চাদর বা ৫-৬টি মাফলার অথবা ৩-৪টি তোয়ালে কিংবা দু’টি শার্ট পিস তৈরি করা যায়। একটি চাদর তৈরিতে সময় লাগে চার দিন। আর জালি চাদর তৈরিতে সময় লাগে দু’দিন। নকশি করা একটি মাফলার তৈরিতে দু’দিন আর নকশি ছাড়া করলে একদিন সময় লাগে। একটি তোয়ালে তৈরিতে লাগে প্রায় দুই দিন। প্রকারভেদে এসব বিক্রিতে লাভের পরিমাণ ৯০ টাকা।
থঞ্জুপাড়ার মাতাওফরু রাখাইন বলেন, আমাদের সম্প্রদায়ের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ। সময়ের বিবর্তনে আবাদি জমি হারিয়ে প্রধান পেশা হয়েছিল তাঁতশিল্প। আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই তাঁতে বস্ত্র বুনতেন। অনেকে সে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন বংশপরম্পরায়। এটি আমাদের ঐতিহ্য হলেও বর্তমানে চলছে দুর্দিন। সুতার দাম বাড়লেও পণ্যের দাম বাড়েনি। তিনি আরো জানান, চাহিদা অনুযায়ী সুতা না পাওয়া, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, আর্থিক সঙ্কট, আধুনিক মেশিন সঙ্কট, সর্বোপরি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা না পাওয়ার কারণে তাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন পটুয়াখালীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজী তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, করপোরেশন থেকে রাখাইন তাঁতশিল্পে জড়িত কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ডিজাইনসহ ঋণসুবিধা দেয়া হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্র প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা