শুভপুর সেতুতে ভারী যান চলাচল বন্ধ ভোগান্তিতে লাখ লাখ মানুষ

ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কে ফেনী-চট্টগ্রাম-খাড়গাছড়ি জেলার সাথে যোগাযোগের ১২ শ’ ফুট দীর্ঘ শুভপুর সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছেন। ধসে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে সড়ক কর্তৃপক্ষ সেতুর মুখে লোহার পিলার দিলেও ঝুঁকি নিয়ে হালকা যানবাহনের সাথে কিছু কিছু ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলছে। অপর দিকে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় প্রতিদিন অর্ধশত কিলোমিটার পথ ঘুরে বিকল্প পথে অর্থ ও সময় নষ্ট করে বেশির ভাগ যানবাহনকে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।
এ দিকে ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই, উত্তর ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলায় শান্তি ও নিরাপত্তায় শুভপুর সেতু গুরুত্বপূর্ণ বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হিসেবে শুভপুর সেতুটি সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য কয়েক বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন তিন জেলায় বসবাসকারী জনপ্রতিনিধিসহ লাখ লাখ মানুষ।
জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু স্থাপনের নকশা প্রণয়ন করে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ৩৭৪ মিটার দীর্ঘ ফেনী নদীর ওপর সরু সেতু নির্মাণ করে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সর্ব বৃহৎ সেতু হিসেবে ফেনী নদীর তীরবর্তী ফেনী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েক কোটি মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে শুভপুর সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমানে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় কার্যত এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে এ অঞ্চলে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলাগুলো থেকে ফেনীসহ দেশের অন্য জেলাগুলোতে চলাচলকারী পণ্যবাহীযান ও যাত্রীবাহীযান চলাচল বন্ধ থাকায় এ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়ক হয়ে প্রয়োজনে শুভপুর সেতু দিয়ে সড়ক পথে চট্টগ্রাম বিভাগের যানবাহন চলাচল করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম নতুন মহাসড়ক চালু হলে ভারী যানবাহনের চাপ কিছু কমে। তবে দ
দুর্ঘটনা বা কোনো কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানযটের সৃষ্টি হলে পুরাতন সড়ক হয়ে দূরপাল্লার যানবাহনগুলোকে চলতে হয়।
১৯৭১ সালে শুভপুর সেতু এলাকায় কয়েক দফায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ওই সময় গোলার আঘাতে সেতুটি বিধ্বস্ত হয়। অসংখ্য সিনেমা, নাটক ও ডকুমেন্টরি তৈরি হয়েছে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ঐতিহাসিক শুভপুর ব্রিজ নিয়ে।
এ অঞ্চলে ইস্পাতের পাতের ওপর নির্মিত সর্ব প্রথম এই সেতুতে কয়েক দশক আগ থেকে ফাটলের সৃষ্টি হয়। কার্পেটিংয়ের রড ধসে যাওয়ায় ও কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় এখন হালকা অটোরিকশা চলাচলের সময়ও দুলতে থাকে সেতুটি। এক দশক আগেই সেতুর মাঝখানে ধসে যাওয়া ও কার্পেটিং ওঠে যাওয়ায় সেতুতে গর্তের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সেতুর ওপর ৭০ ফুট দীর্ঘ ও তিন ফুট উঁচু করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করে দেয়া হয়েছে। এতে সেতুর রেলিং আর সড়ক একই লেবেলে চলে আসায় মারত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে কয়েক দফায় সেতুটি মেরামত করা হলেও কাঠামো দুর্বল হওয়ায় ধসে পড়ার ঝুঁকি নিয়েই চলছে যানবাহন। ভারী ও মাঝারি যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে চলতে দেখা গেছে। সেতুটি ১২ শ’ ফুট দীর্ঘ হলেও প্রস্থে সরু হওয়ায় দু’টি যানবাহন স্বাভাবিকভাবে পাশাপাশি চলাচল করা সম্ভব ছিল না। এতে সেতুর দু-প্রান্তে দীর্ঘ অপেক্ষা ছাড়াও অসংখ্য চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। সেতুটি ধসে পড়লে বড় ধরনের প্রাণহানি ও এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে দুর্বিসহ দুর্ভোগ নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধসহ সর্বমহল।
ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল জানান, শুভপুর সেতুর ওপর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। ভারী ও মাঝারি যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ। ব্রিজটি ভেঙে পড়লে চরম ভোগান্তির শিকার হবে ফেনী, খাগড়াছবি, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রাম জেলার মানুষ। তাই অবিলম্বে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
সম্প্রতি ছাগলনাইয়া উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে শুভপুর সেতু নিয়ে নয়া দিগন্তের প্রতিবেদকের বক্তব্যের বিষয়ে ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার জানিয়েছেন, ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তিনি সংসদে বহুবার আলোচনা করেছেন। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী শুভপুর সেতুটি নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তিনি সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে কথা বলবেন বলে সবাইকে আশস্ত করেন।