২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এই কুঠিতে সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্র করত ঘসেটি বেগম মীর জাফররা

পাবনার হান্ডিয়ালে জগন্নাথ মন্দির ও মীর জাফরের সহচর জগৎশেঠের কুঠি : নয়া দিগন্ত -

এলাকার নাম হাঁড়িয়াল। ইংরেজরা ওদের ভাষার মতো নাসিক্ক ধ্বনিতে উচ্চারণ করত ‘হান্ডিয়াল’। বাঙালিরা শ্বেতপ্রীতি লাভে বলত হান্ডিয়াল। এরপর থেকে পাবনা জেলার চাটমোহররে এই এলাকাটি ‘হান্ডিয়াল’ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানেই ‘অবস্থিত জৎশেঠের কুঠি। সেকালে এই কুঠিতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বিরোধীরা ষড়যন্ত্রের গোপন বৈঠকে করত। কিন্তু সেদিনের এই জনপদ আজ সম্প্রীতির বন্ধন।
শেঠেরবাংলো কার্যত এখন একটি মন্দির। যে স্থাপনা স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসঘাতক সহচর জগৎশেঠ গংকে। কাশিমবাজার কুঠির পর এই বাংলোতেই জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর আলী খাঁ ইংরেজ বেনিয়া ওয়াটসনের সাথে বৈঠক করতেন। এই হান্ডিয়ালেই তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত ছিলেন। শাহী সুবেদারের অধীনে ছিল মুঘলদের পাঁচ হাজার সেনা ও সেনানিবাস। এরও আগে পাঠান রাজত্বকালে প্রমত্তা বড়াল তীরের এই এলাকা ব্যবসাবাণিজ্যের বড় বন্দর ছিল। এখানে মুর্শিদাবাদ থেকে বজরায় ঢাকায় পৌঁছার আগে কিছুটা সময় হান্ডিয়ালে অবস্থান করতেন মুঘলরা।
হান্ডিয়ালের বাজারটি ছিল সমৃদ্ধ। এক দালানে উঠে সব দালানের ছাদে ছাদে ঘুরে আসা যেত। কোম্পানির শাসনামলে উন্নত বন্দর হান্ডিয়ালে গড়ে ওঠে রেশম ও তাঁতের কাপড়ের কেনাকাটার কুঠি। দিনে দিনে ব্যবসার প্রসার ঘটে। এই ব্যবসা এক সময় আরো প্রসারিত হয়ে ভারতবর্ষে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে। ভারতবর্ষে যত রেশম উৎপন্ন হতো তার চার ভাগের তিন ভাগই হান্ডিয়াল বাজারে পাওয়া যেত। এই হান্ডিয়াল থেকেই ব্রিটিশরা রেশম ও তুলা নিয়ে যেত স্বদেশে।
চাটমোহর ও সংলগ্ন হান্ডিয়াল এলাকায় বিশাল আয়তনের যে ৫০টি দীঘি আছে তা এক অপরূপ নিসর্গ। পূর্ণিমার রাতে এই দীঘির জল মৃদু ঢেউ খেলে প্রকৃতিতে নতুন মাত্রা এনে দেয়। এমন নিসর্গ অবগাহনের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারার সব্যসাচী লেখক প্রমথ নাথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালে হরিপুর চৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রমথ চৌধুরী সেই বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ‘ঈশ্বরী পাটনী’ গল্পের সেই মন্ত্রশক্তির মন্দিরটিও রক্ষা করা হয়নি।
এ সবকিছু ছাপিয়ে হান্ডিয়ালের কিংবদন্তি ঘোষ পরিবার। এরা দই ও মিষ্টির এমন ধারা তৈরি করে যে কলকাতার সাহেব-বাবুরা হান্ডিয়ালের মিষ্টি ছাড়া কিছুই বুঝত না। কথিত আছে ইংরেজরা এই এলাকার মিষ্টির জন্য ৭০০ গোয়ালা পালন করত। তাদের কাজ ছিল নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে কলকাতায় পাঠানো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হান্ডিয়ালকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষ পরগনা’ বানিয়ে ব্যবসাবাণিজ্যসহ প্রশসনিক কাজ পরিচালনা করত। হান্ডিয়াল পরগনার সীমানা ছিল অনেক বিশাল। একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে নদী পথেই কয়েক দিন লাগত। অবশ্য ১২৯৪ বঙ্গাব্দের প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে এই জনপদের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য মেলে এখনো। যে কোনো স্থান খুঁড়লে উঁকি দেয় ইট-পাথরের টুকরো। দীঘির জলে ডুব দিলেও পায়ে শক্ত কিছুর ছোঁয়া লাগে।
প্রায় তিন লাখ জনঅধ্যুষিত ৩০৫ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটার হান্ডিয়াল ও চাটমোহর শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। ১৮টি স্কুল, হান্ডিয়াল কলেজসহ সাতটি ডিগ্রি কলেজ একটি মহিলা কলেজ, একটি টেকনিক্যাল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, যা চাটমোহরের শিক্ষাব্যবস্থাকে করেছে আরো সমৃদ্ধ।


আরো সংবাদ



premium cement