২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উত্তরাঞ্চলের চালের বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে

-

উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অটো রাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। গত এক সপ্তাহে চিকন ও মাঝারি মানের চাল দাম ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি বেড়েছে দেড় থেকে ২০০ টাকা। বাজার মনিটরিং না থাকায় এই চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে দাবি করছেন পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ও খুরচা বিক্রেতারা।
গত বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার হাট-বাজারে বোরো ধান আমদানির শুরু থেকেই এই অঞ্চলের ২০০ অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ী লাখ লাখ মণ ধান মজুদ করে বাজার নিজেদের আয়ত্তে রেখেছে। এতে সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।
রাজশাহী ও রংপুর কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় মোট আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ২৭ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৪ হেক্টর। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর এবং রংপুর বিভাগে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬৪ হেক্টর। এ অঞ্চলে জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ১১ শতাংশ রয়েছে শিশু, বৃদ্ধ ও খাদ্য গ্রহণে অনুপযোগী। এই ১১ শতাংশ বাদ দিলে উত্তরাঞ্চলে খাদ্য গ্রহণকারীর সংখ্যা তিন কোটির কিছু ওপরে। একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫৫৩ দশমিক ০৬ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সেই হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি বছর খাদ্যের চাহিদা হচ্ছে ৫৮ লাখ দুই হাজার ১১ টন। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের চাহিদা হচ্ছে ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টন এবং রংপুর বিভাগের চাহিদা হচ্ছে ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ৪১১ টন। গত মৌসুমে আমন, আউশ, গম ও বোরো ফসলের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৪ টন। মোট উৎপাদন থেকে চাহিদা বাদ দিলে দেখা যায় এক বছরে এ অঞ্চলে চাহিদার এক কোটি পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৭১০ টন বেশি খাদ্য উৎপাদন হয়েঠে। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাদ্যা উৎপাদিত উত্তরাঞ্চলে চালের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
উত্তরাঞ্চলে গত এক সপ্তাহ যাবৎ চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আড়তগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণা ৫০ কেজির বস্তা দুই হাজা ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায়, আঠাশ চাল দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়, মিনিকেট দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টাকায়, বাসমতি দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার টাকায়। এ ছাড়া কাটারিভোগ তিন হাজার ৯০০ থেকে চার হাজার টাকায় ও কালিজিরা চাল চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার এখনই যদি এই মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তা হলে এই সিন্ডিকেটটি চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে। তবে অটো রাইস মিল মালিক সমিতি মনে করছে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। একটি মহলের দবি, মৌসুমের শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে মজুদদাররা বেশি বেশি ধান কেনে। এ কারণে সারা বছরই ধানের দাম বেশি। আর এখন যখন বাজারে ধান নাই তখন মজুদদাররা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। তবে ভরা মৌসুমেও চাষি ভালো দাম পেয়েছে। এখন যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে তা আর চাষি পাবে নাÑ এটা পাবে মজুদদাররা।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মোকাম থেকে চাল সংগ্রহ করেন এমন একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ অঞ্চলের পাবনার ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর, রংপুরের মাহিগঞ্জ, দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন মোকাম থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল যমুনা সেতু হয়ে সড়ক পথে, বাঘাবাড়ী নৌবন্দর, নগরবাড়ী নৌবন্দর, বেড়ার বৃশালিখা ও ডাকবাংলা কোলঘাট থেকে নৌপথে ঢাকা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জের কয়েকজন মিল চাতাল মালিক ও আড়তদার জানান, তারা বিভিন্ন মোকাম ঘুরেও অটো রাইস মিলগুলোর কারণে ধান সংগ্রহ করতে পারেননি। অটো রাইস মিল মালিকরা একতরফাভাবে ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। জোতদার ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের হাতে ধান নেই। তারা জানান, পুরো উত্তরাঞ্চলে হাতেগোনা শতাধিক বড় ব্যবসায়ী ও ২০০ অটো রাইস মিল মালিক লাখ লাখ মণ ধানের মজুদ গড়ে তুলেছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা তাদের মিল চাতাল বন্ধ করে দিয়েছে।
উত্তরাঞ্চল চালকল মালিক সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য সরাসরি অটো রাইস মিলগুলোকে দায়ী করে বলেন, অটো রাইস মিল মালিকরা আগে থেকে ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে অটো রাইস মিলগুলোর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে ছোট ছোট মিল চাতাল মালিকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement