২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনার পর বন্যা : ১৫ হাজার তাঁত বন্ধ পাবনা-সিরাজগঞ্জে

বেড়ার পেঁচাকোলায় বানের পানিতে সুতা তৈরিতে চেষ্টারত নারীশ্রমিক : নয়া দিগন্ত -

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে তাঁতিরা ধরতে পারেননি পয়লা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের বাজার। সারা বছরের পুঁজি হারিয়ে ধারদেনা, ব্যাংকঋণ ও দাদন নিয়ে ঈদুল আজহার বাজার ধরার জন্য শাড়ি-লুঙ্গি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন পাবনা-সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা। ঠিক এমন সময়ই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে সর্বনাশা বন্যা। একের পর এক দুর্যোগে সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের। তাঁতকারখানায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় তাঁতিদের পাওয়ারলুমের যন্তপাতি শুধু নষ্টই হয়নি, ব্যাংকঋণ ও দাদনের টাকায় কেনা তাঁতের সুতাও নষ্ট হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ১৫ হাজার তাঁতকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক।
এ দিকে বন্যার পানি ঢুকে অনেক পোলট্রি খামারও ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। খামারিদের পানির দামে ব্রয়লার, লেয়ার মুরগি বিক্রি করতে হয়েছে। তাঁতকারখানা মালিক, পোলট্রি খামারি, বেকার তাঁত শ্রমিকসহ কয়েক লাখ বানভাসি পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। অথচ প্রতি বছর ঈদকে ঘিরে বাহারি নানা ডিজাইনের কাপড় বুনতে নির্ঘুম সময় পার করতে হতো তাঁত শ্রমিকদেরকে। তাঁতের চিরচেনা খট খট শব্দের মাঝে তাঁতিদের উচ্চকিত কণ্ঠের গানে মুখরিত থাকত পুরো তাঁতপল্লী; কিন্তু এ বছর করোনার প্রকোপে লকডাউনের কারণে হাতছাড়া হয়ে গেছে নববর্ষ ও ঈদুল ফিতরের বাজার। মজুদ হয়ে আছে শত শত কোটি টাকার কাপড়। এবার ভয়াবহ বন্যার কারণে ঈদুল আজহার বাজার ধরার আশাও শেষ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদী তীরবর্তী সহস্রাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা, ভাটপাড়া, জগতলা, খুকনী, রুকনাই, জালালপুর, প্রাণনাথপুর, রূপপুর, রূপপুর নতুনপাড়া, উরিরচর, নগরডালা, বাদলবাড়ী, হামলাকোলা, ডায়া নতুনপাড়া, চরপেরজোনা, চৌহালী উপজেলার গোপিনাথপুর, শিবপুর, রুপনাই, গোপালপুর, এনায়েতপুর পুরানবাজার, খামারগ্রাম, ভাঙ্গাবাড়ী, পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার মালদাপাড়া, পেঁচাকোলা, উত্তর পেঁচাকোলা, রাকশা, সাফুল্যাপাড়া, বাটিয়াখরা, নেওলাইপাড়া, সোনাপদ্মা, রূপপুর, খানপুরা, সাঁথিয়া উপজেলার পাথালিয়াহাট, ছোটপাথালিয়াহাট, নগডেমরা, ফরিদপুর উপজেলার বড়ডেমরাসহ তাঁতসমৃদ্ধ অন্তত শতাধিক গ্রাম রয়েছে। করোনার কারণে দু’টি জেলায় আড়াই লাখ পাওয়ারলুম, তিন লাখ হস্তচালিত তাঁত, প্রক্রিয়াজাত রঙ এবং ডিজাইনের সাথে জড়িত প্রায় সাত লাখ তাঁত শ্রমিক এমনিতেই ধুঁকছিলেন। বন্যা তাদের পথে বসিয়েছে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বসতঘরগুলো। সবচেয়ে বড় কথা হলো পানিতে ডুবে থাকায় তাঁত যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরপোরজনা গ্রামের হাতেগোনা ৮-১০টি তাঁতকারখানা ছাড়া প্রায় সবক’টি কারখানায় বন্যার পানি ঢুকেছে। কারখানায় হাঁটু পানির মধ্যে কেউ কেউ শাড়ি তৈরির কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন। তবে যমুনার পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যেই এসব কারখানাও ডুবে যাবে বলে তাঁত শ্রমিকরা জানিয়েছেন। গ্রামের তাঁতকারখানা মালিক আব্দুল্লাহ বললেন, ‘করোনার জন্নি এমনিতেই আমাদের আয়রোজগার বন্ধ হয়া গেছিল। শেষ সম্বল দুইখানা দাদনে টেহা নিয়্যা চালু কইরা বাঁচার আশা করিছিল্যাম। কিন্তু বন্যায় সেই আশাও শেষ হয়া গেল।’
পাবনার বেড়া উপজেলার রাকশা গ্রামের আমিরুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘ঈদের হাটের কথা চিন্তা করে কয়দিন আগে পাঁচখান তাঁত লুঙ্গি তৈরি করে আতাইকুলা ও শাহজাদপর হাটে বিক্রি করলাম। এহনতো তাঁতঘর ডুবে গেছে। ধার করে অনেক টাকার সুতা ও রঙ কিনিছিলাম, সব শেষ।’
বেড়ার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সিল্টু মিয়া জানান, তার ইউনিয়নের ৪ নম্বর ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পেঁচাকোলা ও নতুন পেঁচাকোলা গ্রামে পাঁচ থেকে সাত শ’ তাঁতি পরিবার বন্যাদুর্গত। উপজেলার অন্যান্য গ্রামের আরো চার হাজারের বেশি তাঁতির একই অবস্থা। করোনার পর বন্যার আঘাতে তাঁতিরা নিঃস্ব হওয়ার পথে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকার তাঁতিদের সরকারি কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, বন্যাকবলিত তাঁতিদের বিষয়টি আমি অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখব। বন্যাকবলিতদের জন্য আলাদা কোনো ত্রাণ সহায়তা না এলেও ঈদ উপলক্ষে উপজেলায় বড় ধরনের ত্রাণ সহায়তার (ভিজিএফ) চাল এসেছে। এসব ত্রাণ বিতরণে অসহায় তাঁতিদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement