২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সুনামগঞ্জে ফড়িয়াদের ঘরে কৃষকের ধান

লক্ষ্যমাত্রার ২৫ ভাগও কেনা হয়নি
-

চলমান করোনা পরিস্থিতি আর হঠাৎ বন্যা নেমে আসায় ধান-চাল ক্রয়ে পিছিয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্যবিভাগ। সরকারিভাবে ক্রয়সীমার ৪ মাসের ২ মাস পার হলেও লক্ষ্যমাত্রার ২৫ ভাগও তারা ক্রয় করতে পারেনি। তাতে কৃষকের ধানের স্থান হয়েছে ফড়িয়াদের ঘরে। জেলা খাদ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তারা আশাবাদী। কৃষকরা জানিয়েছে, খাদ্যবিভাগ যে নিয়মে ধান কিনছে তাতে তারা কোনোভাবেই ধান চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। জেলার প্রায় ১০০ মিল মালিককে চুক্তি মোতাবেক চাল দিতে না পারায় কারণ দর্শানোর চিঠিও দেয়া হয়েছে জেলা খাদ্যবিভাগের পক্ষ থেকে।
জানা যায়, চলতি বছর (বৈশাখে) উৎপাদিত প্রায় ১৩ লাখ টন বোরো ধানের ৩২ হাজার ২৬৪ টন ক্রয় করবে সরকার। এ ছাড়াও ১৪ হাজার ৩০৯ টন আতপ চাল ও ১৪ হাজার ৬৮৭ টন সেদ্ধ চাল কিনবে। সুনামগঞ্জে এবার বাম্পার বোরো উৎপাদনের পরেও জেলা খাদ্যবিভাগ ২৯ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ১৯১ টন ধান, ২৪৩৫ টন সেদ্ধ ও ৩০১৩ টন আতপ চাল কিনেছে। হাওর জেলা সুনামগঞ্জে ধান-চাল কেনার এ অবস্থায় কৃষক নেতারা বলেছেন, সরকার যে নীতিতে ধান কিনছে তাতে ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয়। ফেনার বাঁক গ্রামের কৃষক বজলুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকায় প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছি। বাড়ি থেকেই ধান নিয়েছে ব্যাপারী। অন্য কৃষকরাও এভাবে বিক্রি করেছে। খাদ্যগুদামে ধান নিয়ে গেলে ময়েশ্চার, কম শুকনা ইত্যাদি নানা কথা বলে না ধরনের হয়রানি করা হয়। কৃষক রবিউল বলেন, গুদামে ধান নিয়ে যেতে পরিবহন খরচ বেশি। ধান শুকনা কি না এমন ঝামেলার জন্য ধান কৃষকরা গুদামে নিয়ে যেতে আগ্রহী নয়। যাদের নাম লটারিতে উঠেছে তারা অন্য দালাল দিয়ে তাদের নামে গুদামে ধান দিচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কৃষক জানায়, ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে গ্রামের শুকনো ধান নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত এক হাজার ৪০ টাকা থেকে কিছু টাকা কমেও কেনা যাবে, অর্থাৎ পরিবহন খরচের টাকা কৃষকদেরই কম দেয়া যেতে পারে। এতে কৃষকরাও অনায়াসে ধান বিক্রি করবে বলে মনে করছে তারা।
কৃষক হারুন মিয়া জানায়, লটারি বাদ দিয়ে উন্মুক্তভাবে ধান কিনলেও কৃষক সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে এবার ধান দিতে যাবে না। কারণ বাড়িতেই ৯০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। তাহলে পরিবহন খরচ দিয়ে, ইনিয়েবিনিয়ে সরকারি দলের নেতাদের পিছু ঘুরে তদবির করে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে কেন ধান দিতে যাব। সরকার আগে থেকেই আমাদের কথা ভাবেনি। আমরা বলেছিলাম, এবার মোট জাতীয় উৎপাদন কম হচ্ছে। অনেক জমি পতিত থাকছে, কৃষির প্রতি মানুষের অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার তখন আমাদের কথা শুনেনি। মোট জাতীয় উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকের ধান এখন ফড়িয়াদের হাত হয়ে মিলে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক কৃষক। তারা জানান, সরকার হয়তো মিল মালিকদের কাছ থেকে কিছু চাল নিতে পারবে, ধান কিনতেই পারবে না। ধান এখন কিনতে হলে গ্রামে গ্রামে-হাটবাজারে অস্থায়ী ক্রয় কেন্দ্র করে সহজ শর্তে ধান কিনতে হবে। জামালগঞ্জের এক কৃষক আক্ষেপ করে জানান, আমি একজন বড় কৃষক। দলীয় ক্যাডার ও খাদ্যকর্মকর্তার সাথে নানাভাবে লাইন করে ধান দেয়া লাগে। এ কারণে ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় অনেকে কার্ড বিক্রি করে দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সিপিবির সভাপতি চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, সরকার বিদেশ থেকে ধান-চাল আমদানি করবে পত্রিকায় জানলাম। এটি সিদ্ধান্ত হবে ভুল সিদ্ধান্ত। কৃষককের বাড়ি থেকেই সহজ শর্তে ধান কেনা যাবে। কৃষকদের সাথে লিখিত চুক্তি করলেই হবে, ধান গুদামে পৌঁছে দেয়ার খরচ কৃষকের। তাহলে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান কেনা সম্ভব।
সুনামগঞ্জের ধানের আড়ৎ মধ্যনগরে বৃহস্পতিবার ২৯ ধান বিক্রি হয়েছে ৯৩৫ থেকে ৯৪০ টাকা এবং ২৮ ধান বিক্রি হয়েছে ৯৫৫ থেকে ৯৬০ টাকা মণ দরে। প্রতিদিন এই ধানের আড়তে ১০ থেকে ১২ হাজার মণ ধান বেচা-বিক্রি হচ্ছে বলে জানান আড়তের সাবেক সভাপতি জ্যোতির্ময় রায়।
জামালগঞ্জের খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা সালেহ আহম্মদ বলেন, জোন ক্লোজিয়ের ধান কিনা কিছুটা সমস্যা হয়েছে। আমাদের উপজেলায় ৩৭ শ’ টনের কিছু বেশি ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০-৯০০ টন ধান কেনা হয়েছে। তবে যে সময় আছে হাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে আশা করছি।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্যকর্মকর্তা জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, করোনা পরিস্থিতি আর বন্যায় ধান ক্রয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। আশা করি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান আমরা কিনতে পারব। তিনি বলেন, বুধবার পর্যন্ত ছয় হাজার ১৯১ টন ধান কেনা হয়েছে। তিন হাজার ১৩ টন আতপ চাল ও সেদ্ধ চাল দুই হাজার ৪৩৫ টন কেনা হয়েছে। আমরা কৃষকদের জানিয়ে দিয়েছি হয়রানিমুক্ত তারা ধান দিতে পারবে। সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে যেন তারা ধান নিয়ে আসে। বড় কৃষক ৬ টন আর ছোট কৃষক ২ থেকে ৩ টন ধান দিতে পারবে।
চালের ক্ষেত্রে ৩০০ মিলের সাথে চুক্তি হয়েছিল। যারা কিছু দিয়েছে তাদের বুধবার তাগাদাপত্র দেয়া হয়েছে। যারা একেবারেই দেননি এরকম এক শ’-এর বেশি মিল মালিককে কেন চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এ জন্য কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চুক্তি লঙ্ঘন করলে কালো তালিকাভুক্ত হবে, সেটিও উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে চিঠিতে।


আরো সংবাদ



premium cement