১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমফানে লণ্ডভণ্ড চুয়াডাঙ্গা : ৩২ কোটি টাকা ক্ষতি শুধু আমচাষিদেরই

জীবননগরের একটি আমবাগানে ঝড়ে পড়া আমে ছেয়ে গেছে পুড়ো এলাকা (বাঁয়ে); দামুড়হুদায় ক্ষতিগ্রস্ত পেঁপে বাগান : নয়া দিগন্ত -

প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আমফান ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। এর তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে জেলার জনজীবন, নষ্ট হয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ফসল, কোটি কোটি টাকার উন্নতজাতের আম আর মূল্যবান সব স্থাপনা। প্রায় ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও জেলায় আমফানের পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। শুধু আমচাষিদেরই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জীবননগর উপজেলায়।
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় আমফানে চুয়াডাঙ্গার আমবাগানের মালিকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া সময়মতো সব আম বিক্রি করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়েও তারা এখন চিন্তায় আছেন। পর পর দু’টি ঝড়ে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে জেলায় এক হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। চলতি মৌসুমে এক হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। সে হিসেবে চলতি মৌসুমে ৩০ হেক্টর জমিতে আমের নতুন বাগান হয়েছে। এসব বাগান থেকে ফলন হবে ২৯ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন আম। পাইকারি এক হাজার ২০০ টাকা মণ হিসাবে ৮৯ কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা ছিল এসব আমের। তবে সাম্প্রতিক ঝড়ে ১০ হাজার ৫৮৪ মেট্রিক টন আমের ক্ষতি হয়েছে, যার মূল্য ৩১ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।
এ মৌসুমে আম বিক্রি করে সারা বছরের বাগান পরিচর্যা ও শ্রমিকের মজুরি উঠে আসবে না বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
চুয়াডাঙ্গার আম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, চুয়াডাঙ্গায় এবার আমের ফলন ভালো হয়েছে। তবে করোনার কারণে বাজারজাত করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। তবে আমাদের এলাকার হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, আম্রপালিসহ অনেক ভালো ভালো জাতের আম রয়েছে। এসব আম খুবই সুস্বাদু, দেশ-বিদেশে এর খ্যাতি আছে। তবে পরপর দু’টি ঝড়ে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ মৌসুমে আম বিক্রি করে সারা বছরের বাগান পরিচর্যা ও শ্রমিকের মজুরি উঠে আসবে না।
আম বর্গাচাষি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদিত আম জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলার মোকামে পাঠানো হয়। কিন্তু করোনার কারণে এই আম বাজারজাত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আলী হাসান বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার হিমসাগর আম বিখ্যাত। এ জেলা থেকে বিভিন্ন মোকামে আম পাঠাতে বা বিক্রি করতে কোনো ধরনের সমস্যা যাতে না হয় সে দিকে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি।
দামুড়হুদা সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় কলা, পেঁপে, আম, সবজি, পানবরজ, বোরো ধান, মুগডাল ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি টাকারও বেশি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। চাষিদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কঠিনই হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, এ জেলায় প্রচণ্ড বেগে সুপার সাইক্লোন আমফান আঘাত হানে। ফসলের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ কোটি ২৮ লাখ ৪ হাজার টাকা। চাষিদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কঠিনই হবে। চাষিদের মাঝে দ্রুত বিনামূল্যে সার, বীজ ও বিনাসুদে ঋণ বিতরণের প্রয়োজন।
জীবননগর সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় উঠতি ফসল, ঘরবাড়ি, গাছপালা, পুকুর ও জলাশয়ের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে ও বাগানের আম ঝরে পড়ে কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঝড়ের তাণ্ডবে বিভিন্ন খাতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ঝড়ের সময় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলা এর আগে ঝড়ের এমন তাণ্ডব কেউ কখনো দেখেনি।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শত শত বিঘা বাগানের আম ঝরে পড়ে গাছের নিচে স্তূপ আকারে পড়ে আছে। আমসহ বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে আছে। বেশির ভাগ গ্রামের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভুতুড়ে অবস্থায় ভ্যাপসা গরমে গ্রামের মানুষ অসহনীয় দিন যাপন করছে। ১৩-১৪ ঘণ্টার বিরতিহীন এমন ঝড় এলাকার প্রবীণ লোকরাও দেখেননি।
গয়েশপুর গ্রামের বাবলুর রহমান বাবলু বলেন, আমি এবার আমার নিজের এবং চাষিদের নিকট থেকে কেনা বাগান মিলে ৬০ বিঘা জমির আমবাগান ছিল। গত কয়েকদিন আগেও বাগানের প্রতিটি গাছের থোকায় থোকায় আম ঝুলছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবারে আমফান ঝড়ের তাণ্ডবে গাছের ৮০ ভাগ আম ঝরে পড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এমন ক্ষতি আগে কখনো হয়নি। ৬০ বিঘা বাগানের আম ৪০ লাখ টাকায় বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঝড়ের তাণ্ডব আমাদেরকে পথে বসিয়েছে।
উপজেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের আব্দুল হান্নান বলেন, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঝড়ের যে তাণ্ডব দেখেছি তাতে বেঁচে আছিÑ এটাই বড় কথা। দালানঘরেও রাতভর আতঙ্কের মধ্যে কাটিয়েছি। ঝড়ের তাণ্ডবে ঘরের ওপর গাছ পড়ে আমাদের গ্রামের শিশু জুবায়ের (১২) ও জীবননগর শহরের বৃদ্ধা মোমেনা খাতুনের (৮৫) করুণ মৃত্যু হয়েছে। মাঠের কলাগাছ তো সব শেষ। আম গাছ, নিম গাছ, পেঁয়ারা গাছ, মেহগনি গাছ, বাঁশঝাড় উপড়ে পড়ার পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষ এমনিতেই কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তার ওপর এমন ঝড়ের ক্ষতি মানুষ কিভাবে পুষিয়ে উঠবে? এতে এলাকার মানুষের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে।
উপজেলার মাধবখালী গ্রামের মৎস্যচাষি রাজেদুল ইসলাম বলেন, শত শত বিঘা পুকুর গেছে ভেসে। অনেক জলাশয়ের বাঁধ ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। আমার ২০ বিঘা জমির পুকুর পানিতে ভেসে গিয়ে ২০ লাখ টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে।
একই গ্রামের গরু খামারি ফারুক হোসেন বলেন, আমার গো-খামারের টিন উড়ে গেছে এবং দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওইদিন ঝড়ের ভয়ে অনেক মানুষ মসজিদ থেকে বের হতে পারেননি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় সদ্যনির্মিত রাস্তা ধসে পড়েছে। বড় বড় গাছ ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। জমির কাটা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পুকুর কিংবা জলাশয় পানিতে তলিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সারমিন আক্তার বলেন, আমফান ঝড়ে উঠতি ফসল বোরো ধান, শাকসবজি, কলা, মুগ, পেঁপে, পান ইত্যাদি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সব মিলিয়ে ২০ কোটি টাকা পার হয়ে যাবে। আমরা ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন দিয়েছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমফান ঝড়ের তাণ্ডবে উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে। তবে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পুঁষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে।


আরো সংবাদ



premium cement