১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিলুপ্তির পথে লালমোহনের ঐতিহ্যবাহী হোগলা শিল্প

-

ভোলার লালমোহনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবারের প্রায় বেশির ভাগ সদস্যই বংশপরম্পরায় হোগলা তৈরির পেশার সাথে জড়িত; কিন্তু বর্তমানে মহাজনদের দৌরাত্ম্য ও ডিজিটালের ছোঁয়ায় হোগলাপাতা চাষের জমি কমে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক জোগানদাতা।
হোগলাপাতার ইংরেজি নাম সি-গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস। উপকূলীয় এলাকার মানুষের কাছে এই হোগলা সংসারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাড়তি আয় রোজগারের একটি মাধ্যম। একসময় হোগলাপাতার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল শুধু চাটাই তৈরিতে। সময়ের পরিবর্তনে এই পাতার নানা মাত্রিক ব্যবহার হচ্ছে। হোগলাপাতা দিয়ে বিছানা, দড়ি, ফ্লোরম্যাট, টেবিল, রান্নার সামগ্রী রাখার ঝুড়ি, লন্ড্রি বাসকেট, পেপার, ট্রে, ফলের ঝুড়ি, শোপিস-সহ বিভিন্ন পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। বেত ও বাঁশের চেয়ে দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এসব সামগ্রী তৈরিতে খরচও কম। পাশাপাশি পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় হোগলার দড়ি দিয়ে তৈরি নানা তৈজসপত্র আন্তজার্তিক বাজারে ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। সুযোগ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার চরভূতার নম গ্রামেই হোগলা তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি।
হোগলা শিল্পী রণজিৎ দাস, বালা রানী দাসসহ কয়েকজন জানান, একসময় হোগলার মাদুর ছিল শৌখিনতার প্রতীক; কিন্তু হোগলাপাতার সরবরাহ কম, আধুনিক পণ্যসামগ্রীর আধিপত্য ও প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন। শীতের দিনে হিন্দু পরিবারগুলো হোগলার পণ্য তৈরির কাজে নেমে পড়ত সংসারের বাড়তি আয়ের আশায়। গ্রামের কৃষক, দিনমজুর, মুচিসহ অনেকেই এ পেশার সাথে জড়িত। এসব কুটির শিল্পীর অভিযোগÑ বর্তমানে হোগলাপাতার দাম বৃদ্ধি ও মজুরির ন্যায্য মূল্য তারা পাননা বিধায় এ কাজে তারা উৎসাহ হারাচ্ছেন। উপজেলার কালমা ইউনিয়ানের চরলক্ষ্মী গ্রামের হোগলার কারিগর প্রভাত দাস জানান, সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হোগলাপাতার কাঁদি ডগা লাগানোর উপযুক্ত সময়। জমি চাষ দিয়ে তৈরি করে ছাই, গোবর বা সবুজ সার দিয়ে অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করা হোগলাপাতার কাঁদি ডগা এক-দেড় ফুট ফাঁকে ফাঁকে লাইন করে লাগানো হয়। ১৫-২০ দিন পর কাঁদি ডগার গোড়ায় গোড়ায় চারা গজাতে শুরু করে। এই চারা ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা হলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে পাতা মোটা ও ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়। পৌষ মাসে পাতা কেটে ভালো করে রোদে শুকিয়ে আঁটি বাঁধা হয়। একবার কোনো জমিতে হোগলাপাতার চাষ করলে ওই জমিতে নতুন আর চারা লাগানোর দরকার হয় না।
কালমা গ্রামের রামদাস বলেন, বাজারে সাধারণত পাঁচ হাত দৈর্ঘ্য ও চার হাত প্রস্থ হোগলার বিছানা পাওয়া যায়। একেকটি বিছানার দাম ৪০-৫০ টাকা, আর দড়ি তৈরির জন্য বড় এক বান্ডেল হোগলাপাতার দাম ৩০০-৪০০ টাকা, যা থেকে সাত হাজার হাতের বেশি দড়ি তৈরি হয় এবং প্রতি হাত দড়ি ১০-১২ টাকা বিক্রি করা হয়। লেছ ছকিনা গ্রামের স্বপন দাস জানান, একটি বেতের বাসকেট তৈরিতে খরচ হয় ১২-১৩ শ’ টাকা, আর হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি করলে খরচ পড়ে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তা ছাড়া হোগলাপাতার ফুল বা রেণু সুস্বাদু খাবার হিসেবে মানুষ শখ করে খায়। এর গুঁড়ো বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে হোগলার তৈরি নানা পণ্যসামগ্রীর কদর বাড়ছে। হোগলাপাতার শিল্পের সাথে জড়িত স্থানীয় দরিদ্র পরিবারগুলোর কিছু সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ এবং আন্তজার্তিক বাজারে আরো প্রসার ও পরিচিতি বাড়াতে পারলে দেশের সম্ভাবনাময় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা এবং এ আয়ের পেশা টিকে থাকবে বলে মনে করে সচেতন মহল।

 


আরো সংবাদ



premium cement