২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে নারী কুস্তিগিরকে কোনো পুরুষ হারাতে পারেনি

যে নারী কুস্তিগিরকে কোনো পুরুষ হারাতে পারেনি - ছবি : সংগৃহীত

১৯৫০ -এর দশকে যখন ভারতে নারীদের কুস্তি লড়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তখনই পুরুষ পালোয়ানদের একটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেছিলেন হামিদা বানু। ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দু’জন পুরুষ চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির হেরে গিয়েছিলেন হামিদা বানুর কাছে। ওই দু’জনের একজন ছিলেন পাটিয়ালার, অন্যজন কলকাতার।

ওই বছরের মে মাসে তৃতীয় লড়াইয়ে নামার জন্য হামিদা বানু বরোদার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তার বরোদা আসার কথা জেনে শহরে একটা হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বরোদার বাসিন্দা, পুরস্কৃত খো-খো খেলোয়াড়, ৮০ বছর বয়সী সুধীর পরব ওই সময়ে স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, আমার মনে আছে, এ সময়ে ওই লড়াইটা মানুষের কাছে খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এর আগে এরকম কোনো কুস্তির লড়াইয়ের কথা আগে কেউ শোনেনি। কুস্তির লড়াই দেখার জন্য প্রাচীন ইউনানি লড়াইয়ের মতো করে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু হামিদা বানু দর্শকদের কৌতুহল মেটানোর জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন।

সংবাদ এজেন্সি ‘এপি’ প্রতিবেদন করেছিল, ওই লড়াই মাত্র এক মিনিট ৩৪ সেকেন্ড ধরে চলেছিল। হামিদা বানু বাবা পালোয়ানকে চিৎ করে ফেলেছিলেন। রেফারি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে- বাবা পালোয়ানের হামিদা বানুকে বিয়ে করার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। হামিদা বানুর প্যাঁচ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ বাবা পালোয়ানও ঘোষণা করেন যে- সেটিই ছিল তার শেষ ম্যাচ। ভারতের প্রথম পেশাদার নারী কুস্তিগির হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা হামিদা বানু সাহসের সাথে সেই সব চিরাচরিত কাহিনীগুলোকে বদলিয়ে দিচ্ছিলেন, যেখানে নারীদের দুর্বল হিসেবে দেখানো হতো। সেই সময়ে কুস্তিকে পুরুষদের ক্রীড়া বলেই দেখানো হতো।

হামিদা বানু এতটাই চর্চিত নাম হয়ে উঠেছিলেন যে- তার ওজন, উচ্চতা, খাদ্য তালিকা, সব কিছু নিয়েই আলোচনা হতো। যা জানা যায়, হামিদা বানুর ওজন ছিল ১০৭ কেজি আর তিনি ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। প্রতিদিন তার খাদ্য তালিকায় থাকত সাড়ে পাঁচ কিলো দুধ, পৌনে তিন কিলো সুপ, সওয়া দুই লিটার ফলের রস, একটা গোটা মুরগি, প্রায় এক কিলো খাসির মাংস, ৪৫০ গ্রাম মাখন, ছয়টা ডিম, এক কিলো বাদাম, দুটো বড় রুটি আর দুই প্লেট বিরিয়ানি। এটাও বলা হতো যে- তিনি দিনে নয় ঘণ্টা ঘুমাতেন আর ছয় ঘণ্টা কসরত করতেন। হামিদা উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তবে সালাম নামে এক পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখার জন্য তিনি আলিগড়ে চলে আসেন।

হামিদা বানুর প্রশংসা করতে গিয়ে এক স্থানীয় সাংবাদিক লেখেন, তার সাথে কোনো নারীর লড়াই করার সুযোগ যে পাওয়া যায় না, তার কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব, তাই তাকে বাধ্য হয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলা করতে হয়। হামিদা বানুর আত্মীয়দের সাথে কথা বলে এটা জানা যায় যে- প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা কম থাকার পাশাপাশি সমাজের প্রাচীনপন্থীদের ভাবনা চিন্তার কারণেও ঘর ছেড়ে তাকে আলিগড়ে গিয়ে থিতু হতে হয়েছিল।

পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে লড়াই
১৯৫৪ সালে যখন হামিদা বানু চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রেখেছেন, সেই সময়ে তিনি দাবি করতেন যে- ততদিনে তিনি ৩২০টি কুস্তির লড়াই জিতে ফেলেছেন। তার উৎকর্ষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সে যুগের গল্প কাহিনীতেও তার ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হতো। এরকম গল্পও আছে যেখানে বিয়ের পাত্রের শক্তিকে হামিদা বানুর শক্তির সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এসব মিলিয়েই বরোদার মানুষের কাছে কৌতুহলের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলেন হামিদা বানু।

সুধীর পরব বলেন, এক নারী পালোয়ান কোনো পুরুষ পালোয়ানের সাথে লড়াইতে নামছেন, এটাই ছিল কৌতুহলের মূল কারণ। ১৯৫৪ সালে মানুষ বেশ প্রাচীনপন্থীই ছিল। তারা এটা মানতে প্রস্তুত ছিল না যে- এরকম কোনো কুস্তির লড়াই হতে পারে। শহরে তার আসার ঘোষণা করা হয়েছিল নানা ব্যানার-পোস্টার লাগিয়ে, যেগুলোতে হামিদা বানুর প্যাঁচের কায়দার উল্লেখ করা থাকতো। ঠিক যেভাবে সিনেমার প্রচার হতো, এই লড়াইয়ের প্রচারও সেভাবেই করা হয়েছিল। আমার মনে আছে হামিদা বানু প্রথমে ছোট গামা পালোয়ানের সাথে লড়বেন বলে ঠিক ছিল। লাহোরের বিখ্যাত গামা পালোয়ানের নামের সাথে মিল রেখেই এই ছোট গামা পালোয়ানের নাম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে ছোট গামা পালোয়ান হামিদা বানুর সাথে কুস্তি লড়তে অস্বীকার করেন।

কোনো কোনো কুস্তিগির মনে করতেন যে- নারী পালোয়ানের সাথে কুস্তি লড়া একটা লজ্জাজনক ব্যাপার। অন্যদিকে অনেক মানুষ ক্ষুব্ধও ছিলেন যে- একজন নারী সবার সামনে পুরুষদের লজ্জাজনক ভাবে হারিয়ে চলেছেন।

মহারাষ্ট্রের কোলাপুর শহরে শোভা সিং পাঞ্জাবী নামে এক কুস্তিগিরের সাথে লড়াইয়ে নেমেছিলেন হামিদা বানু। লড়াইয়ে ওই পুরুষ কুস্তিগির হেরে যাওয়ায় কুস্তি-প্রিয় মানুষজন নানা কথা শোনায় হামিদা বানুকে, তার ওপরে পাথরও ছোঁড়া হয়। ভিড় সামলাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। অনেক সাধারণ মানুষ তো হামিদা বানুর ওই জয়কে বানোয়াটও বলেছিল। তবে বিষয়টা সেখানেই থেমে থাকেনি।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement