২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

হিমালয়ের বিপদ তৈরি করছে চীন ও ভারতের সীমান্ত স্থাপনা

সড়ক তৈরি আর প্রশস্ত করার কারণে হিমালয় এলাকায় বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে। - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের উত্তরাঞ্চলে হিমালয়-ঘেঁষা শহর জোশিমঠের ভূমি ও আশপাশের এলাকায় ফাটল দেখা দেয়ার পর বেশ কয়েক দিন ধরেই বিষয়টি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। শহরটি ডুবে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিজ্ঞানীরা বলছে, হিমালয় ঘিরে আরো বড় একটি ভয়ের বিষয় আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।

তারা বলছে, হিমালয় অঞ্চল ঘিরে যে হারে ভারত ও চীন বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়েছে, তাতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

একই সাথে বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে হিমালয় অঞ্চলের নাজুক ইকো সিস্টেম হুমকির মুখে পড়েছে। বড় বড় হিমবাহগুলো আর স্থায়ী বরফে ঢাকা এলাকাগুলোতে বরফ গলতে শুরু করেছে।

বিশেষ করে ভারত ও চীনের যেসব এলাকায় মহাসড়কগুলো তৈরি করা হচ্ছে, রেলওয়ের লাইন বসানো হয়েছে, টানেল তৈরি করার জন্য পাহাড় খনন করা হচ্ছে, বাঁধ আর বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে, উভয় অংশেই এই চিত্র আরো পরিষ্কার হচ্ছে।

নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও জলবিদ্যার অধ্যাপক আন্দ্রেস কাব বলছেন, ‘আসলে এর মাধ্যমে বিপদকে আরো কাছে ডেকে আনা হচ্ছে।’

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলায় ২০২১ সালে ভয়াবহ তুষার ধসের কারণ নিয়ে যৌথভাবে তিনি একটি বই লিখেছেন।

বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ঘটনা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু যখন সেগুলোর ফলাফল একত্রে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তখন দেখা গেছে যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে, যে এলাকাটিকে ভারত ও চীন-দুই দেশই তাদের সীমানা বলে মনে করে।

এই সীমানাকে বলা হয় লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল।

প্রতি কিলোমিটারে ভূমিধস
ন্যাচারাল হ্যাজার্ড অ্যান্ড আর্থ সিস্টেম সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে ভারতের জাতীয় মহাসড়ক এনএইচ-সেভেনের প্রতি কিলোমিটারে অন্তত একটি করে ভূমিধস হয়েছে। যার ফলে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অন্য গবেষণাগুলোতেও অনেকটা একই ধরনের বিপদের ঝুঁকি শনাক্ত করা হয়েছে।

ইউরোপিয় জিওসায়েন্স ইউনিয়নে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিবেশগত অবস্থার পাশাপাশি নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করা বা প্রশস্ত করার কর্মকাণ্ড নতুন ভূমিধস তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এসব ভূমিধস প্রায়ই ছোটখাটো বা অগভীর হয়ে থাকে, কিন্তু তাতেও প্রাণহানি হয়। কারণ এতে যানবাহন চলাচল ও স্থাপনাগুলোর গুরুতর ক্ষতি হয়ে থাকে।

ওই এলাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিধস ও অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিনে দিনে খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। এমনকি গত বছর বর্ষাকালে উত্তরাখণ্ডে নবনির্মিত চারধাম মহাসড়কের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছিল।

চামোলি তুষার ধসের সময় ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত আর নির্মাণাধীন দুটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ওই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ভারতের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দেখতে পেয়েছে, ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবেলা করা নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় তাদের কর্মকর্তারা জলবায়ু ও অবকাঠামো সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোকে বিবেচনায় নেয়নি।

হিমালয় অঞ্চলের জন্য অবকাঠামো বা স্থাপনাগুলো যে হুমকি তৈরি করছে, এই সম্পর্কিত বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ভারতের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি হিমালয়ের ভারতের দিকে যেমনটা রয়েছে, চীনের দিকেও সমান ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে চিরস্থায়ী বরফ এলাকাগুলোয় তৈরি করা অবকাঠামো বরফ গলিয়ে দিতে হুমকি তৈরি করেছে।

গত অক্টোবরে কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের কিংহাই তিব্বত মালভূমিতে প্রায় নয় হাজার ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা, ৫৮০ কিলোমিটার রেলপথ, দুই হাজার ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি বিদ্যুৎ লাইন এবং হাজার হাজার ভবন এসব চিরস্থায়ী বরফ এলাকায় রয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিরস্থায়ী বরফ এলাকাগুলো গলতে শুরু করায় ২০৫০ সালের মধ্যে ৩৪ ভাগ সড়ক, ৩৮ ভাগ রেলপথ, ৩৭ ভাগ বিদ্যুতের লাইন, ২১ ভাগ স্থাপনা বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে পারে।

এসব কারণে চীনের পূর্ব তিব্বত, ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং সিমি রাজ্যের উত্তরে ভূখণ্ড শুষ্ক ও কঠিন হয়ে পড়ছে। সেসব এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো প্রাকৃতিক পথ থেকে সরে গিয়ে ছড়িয়ে যাওয়ারও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

গত বছর দ্যা ক্রায়োস্ফিয়ার জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই অঞ্চল একাধিক উচ্চ মাত্রার বরফ-পাথর তুষার ধস, হিমবাহ সরে যাওয়া ও হিমবাহের হ্রদ উপচে বন্যার সম্মুখীন হয়েছে।

এই মাসের শুরুতে, তিব্বতের মেডোগ কাউন্টিতে একটি সুড়ঙ্গ মুখে তুষারধসে ২৮ জন নিহত হয়েছে।

তিব্বতের এই বোমি অংশেই ২০০০ সালে ভূমিধস হয়ে সব সেতু, সড়ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছিল, যেগুলো তৈরি করতে কয়েক দশক সময় লেগেছে।

দ্যা ক্রায়োস্ফিয়ার জার্নালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই অঞ্চলটি উচ্চ গতির ‘সিচুয়ান-তিব্বত রেলপথ’ নির্মাণসহ চীনা সরকারের বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন, এই রেলপথটি ২১টি তুষার ঢাকা পাহাড়ের (সমুদ্রের চার হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার) ওপর দিয়ে যাবে এবং ১৪টি বড় বড় নদী অতিক্রম করবে।

চীনা অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের মাউন্টেন হ্যাজার্ডস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইন্সটিটিউটের প্রধান প্রকৌশলী ইউ ইয়ং সিনহুয়া নিউজ এজেন্সিকে বলেছেন, অবশ্য ভূখণ্ডগত সমস্যা ছাড়াও এই রেলওয়ে তুষারধস, ভূমিধস ও ভূমিকম্পের মতো অন্য বিপদের মুখোমুখি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিংচি ও শিগাৎসের মতো স্থানে বসতি বৃদ্ধির আরেক অর্থ হলো, ওই এলাকায় সড়ক ও টেলিযোগাযোগসহ অবকাঠামো বেড়ে যাওয়া।

চীনা গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী রবি বার্নেট বলেছেন, ওই এলাকায় তারা ৬২৪টি নতুন সীমান্ত বসতি তৈরি করেছে। যেগুলোর প্রতিটিতে রাস্তা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি সরবরাহ এবং আরো অনেক কিছুর বিস্তৃত অবকাঠামো থাকতে হবে।

তিনি বলছেন, ‘এগুলোর অনেকগুলো অস্বাভাবিক উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে, চার হাজার মিটারের বেশি উঁচুতে, যেখানে আমাদের জানা মতে এর আগে মানববসতি কখনো হয়নি। সেখানে বসতির জন্য যে হারে নির্মাণ সরঞ্জাম, সরবরাহ ও আরো অনেক কিছুর দরকার হবে, তাতে সেটা অসম্ভব বলে মনে করা না হলেও, অবাস্তবধর্মী বলে মনে করা হতো।

এই বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য চীনের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

চীনের যে এলাকায় নতুন বসতি তৈরি করা হয়েছে, তার দক্ষিণ দিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিমের মতো রাজ্য রয়েছে, যেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এগুলো হলো সেইসব রাজ্য, যেগুলোকে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে হ্রদ ও জলাশয়ের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণের জন্য চিহ্নিত করেছে।

আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভারতের ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহ হ্রদের মধ্যে ১৭টি সিকিমে ছিল। গলিত হিমবাহের কারণে এই হ্রদগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া ও উপচে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করায় এগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

অংশীদার ও প্রতিদ্বন্দ্বী
জলবায়ু আলোচনার সময় চীন ও ভারত সবসময়েই তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে একত্রে কাজ করেছে, অনেক সময় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছে, হিমালয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও পরিবেশগত অন্য সমস্যা মোকাবেলার প্রসঙ্গ এলে এই অংশীদারিত্ব কাজ করে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বৈরিতার কারণে এশিয়ার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ হিমালয়ের এই বিপদজ্জনক এলাকায় সামরিকসহ সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে।

আমেরিকান ভূ-বিজ্ঞানী জেফরি কার্গেল বলছেন, ‘এই এলাকায় একটা আন্তর্জাতিক জৈববৈচিত্রের সংরক্ষিত এলাকা বলে চিহ্নিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে কোনোরকম ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেয়া উচিত ছিল না।’

তিনি বলছেন, ‘কিন্তু আমরা আজ হিমালয়ে যা দেখছি, তাতে বিপদের ঝুঁকি আরো বাড়ছে এবং তার ফলে এই অঞ্চল আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়ছে। আমরা এখানে আরো অনেক অনেক বিপর্যয় দেখতে যাচ্ছি।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ

সকল