২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৌদি-চীন নৈকট্য নিয়ে বিচলিত, ইরানি প্রেসিডেন্ট বেইজিংয়ে

বেইজিংয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ১৪/০২/২০২৩। - ছবি : বিবিসি

কূটনৈতিক সম্পর্ক বিবেচনায় সৌদি-চীন নৈকট্য নিয়ে কিছুটা বিচলিত হলেও এই দু‘দেশ ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। একই কারণে ইরানি প্রেসিডেন্টও বসে নেই, তিনি এখন বেইজিংয়ে আছেন।

মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট শির আমন্ত্রণে তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং পৌঁছেছেন। গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো ইরানি প্রেসিডেন্ট চীন সফর করছেন।

ইরানি নেতার চীন সফর নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ আমেরিকার তীব্র চাপের মধ্যে পড়া এই দু‘দেশ গত বছরগুলোতে ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

দু‘দেশ ২০২১ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি সই করেছে। আগামী ২৫ বছরে ইরানে ৪০ হাজার কোটি ডলার চীনা বিনিয়োগ হবে বলে লক্ষ্য ধার্য হয়েছে। ইরানের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ অবকাঠামোর সর্বক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ হচ্ছে। চীনা প্রকৌশলীরা সেখানে রাস্তা, সেতু ও রেল লাইন নির্মাণ করছে। ফলে দু‘দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর চলবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ডিসেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্টের সৌদি আরব সফরের সময় উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট জিসিসির নেতাদের নিয়ে তার এক শীর্ষ বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ ঘোষণা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ইরানে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরপরই এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসলামিক রিপাবলিক কোনো দেশকে ইরানের ভৌগলিক সার্বভৌমত্বের অমর্যাদা করতে দেবে না।’ স্পষ্টতই তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন চীনের দিকে। তেহরানে চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এনে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে পড়ে যে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার রিয়াদ সফর শেষে দেশে ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যে চীনা ভাইস প্রিমিয়ার বা উপ-প্রধানমন্ত্রী হু চুনহুয়াকে তেহরান পাঠান।

তেহরানে গিয়েই ক্ষুব্ধ ইরানি নেতাদের আশ্বস্ত করতে হু বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘ইরানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীন সবসময় পাশে থাকবে।’ অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এবারে একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে ইরানকে আশ্বস্ত করতেই রাইসিকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন শি জিন পিং। বেইজিংয়ের মধ্যপ্রাচ্য নীতিও হয়তো খোলাসা করে ব্যাখ্যা করা হবে তার কাছে।

হামদি বলেন, ‘লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সম্পাদক এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি বলেন, শি জিনপিংয়ের রিয়াদ সফরের সময় জিসিসি জোটের সাথে শীর্ষ বৈঠক নিয়ে তেহরান-বেইজিং সম্পর্কে যে ‘কালো ছায়া’ পড়েছিল সেটি সরানোর চেষ্টা হচ্ছে। ‘রাইসির এই সফর তিন দিনের। এত লম্বা এক সফরে তাকে আমন্ত্রণ করে শি স্পষ্টতই ইরানকে বোঝাতে চেয়েছেন আমরা কখনই তোমাদের সাথে সম্পর্ককে খাটো করে দেখছি না।’

ইরান উদ্বিগ্ন কেন? প্রেসিডেন্ট শির সৌদি আরব সফর নিয়ে কেন ক্ষুব্ধ হয় ইরান?
সৌদিআরব ইরানের এক নম্বর আঞ্চলিক শত্রু। কয়েক বছর ধরে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন। বছরের পর বছর ধরে এই দু‘দেশ ইয়েমেনে রক্তাক্ত এক ছায়া-যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু, সামি হামদি বলেন, সৌদি আরবে সফর নয়, বরঞ্চ সমস্যা বাধে রিয়াদে জিসিসি নেতাদের সাথে শির শীর্ষ বৈঠকের পর প্রকাশিত বিবৃতিটি নিয়ে।

ওই বিবৃতিতে একাধিকবার ইরানের প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে ‘শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির’ জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ‘প্রতিবেশীদের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ নীতি অনুসরণে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলানোর’ আহ্বান জানানো হয়। একই সাথে তিনটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

সামি হামদি বলেন, ‘ওই বিবৃতি প্রকাশের পর ইরানের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, ইরানের ব্যাপারে উপসাগরীয় দেশগুলোর যেসব অভিযোগ, সেগুলো বেইজিং পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে, এতেই তেহরান ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।’

চীন সম্পর্কে ভারসাম্য চাচ্ছে
ইরানের স্পর্শকাতরতা জেনেও কেন শি জিনপিং জিসিসির সাথে যৌথ ঘোষণার ভাষাকে ততটা গুরুত্ব দেননি?

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীন গত দু‘দশক ধরে সৌদিআরব এবং ইউএইসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর জোর চেষ্টা করে চলেছে। তারা ইরান এবং তার উপসাগরীয় বৈরি প্রতিবেশীদের সাথে সমান্তরাল একটি সম্পর্ক চাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের কৌশলগত গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকায় উপসাগরীয় দেশগুলোও তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে চীনের সাথে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। জিসিসি জোটের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য ২০০৪ সাল থেকে চীন চেষ্টা করে গেলেও বিভিন্ন আপত্তি ও সন্দেহে তা বাস্তবে রূপ পায়নি। কিন্তু ডিসেম্বরে শি জিন পিংয়ের রিয়াদ সফরের পর এখন উপসাগরীয় সূত্রগুলো থেকে বলা হচ্ছে, এ বছরেই ওই চুক্তি হয়ে যেতে পারে।

চুক্তি ছাড়াই উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে চীনের বাণিজ্য ক্রমাগত বাড়ছে এবং ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়েছে। এই অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের ১৭ শতাংশ হচ্ছে শুধু চীনের সাথেই। চীন এখন সৌদি আরবের এক নম্বর বাণিজ্য সহযোগী দেশ। ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে দু’দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯০০ কোটি ডলার।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথেও চীনের বাণিজ্য বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। গত বছর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৯৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায় যা ছিল ২০২১ সালের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি। সে তুলনায়, ইরানের সাথে গত বছরে চীনের ব্যবসা হয়েছে ৩০০০ কোটি ডলার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরানের পাশাপাশি উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ককে এখন বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে চীন।

কুয়ালালামপুরে মালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন,‘চীনা পররাষ্ট্র নীতির প্রধান দিক হলো তারা কখনই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলায় না। এমনকি একটি মিত্র দেশের সাথে কথাবার্তায় তৃতীয় আরেকটি দেশ নিয়েও তারা কথা বলতে চায় না। এই বিষয়টি সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের স্বস্তি, যে মানবাধিকার বা নৈতিকতা নিয়ে আমেরিকানদের বক্তৃতা তাদের শুনতে হচ্ছেনা।’

জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ
কিন্তু শিয়া ইরান এবং সুন্নি সৌদি আরবের সম্পর্কে বৈরিতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির অন্যতম বাস্তবতা। ফলে এই দু‘পক্ষের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য রাখা কতটা সহজ হবে চীনের জন্য? সহজ যে হবে না তা ডিসেম্বরে রিয়াদে শি জিনপিংয়ের সফরের পরই অনেকটা বোঝা গেছে।

তবে, ড. আলী বলেন, ইরান এবং সৌদি আরব দু’পক্ষই বৈরিতা কমানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব দেখতে পারছে ইয়েমেনের যুদ্ধে তাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ হচ্ছে না। তাদের টাকা-পয়সা এবং সুনাম দুটিই নষ্ট হচ্ছে, কিন্তু নিরাপত্তার প্রতি ঝুঁকি বাড়ছে ... কাতার তো বেশ কিছুদিন ধরে স্পষ্ট করে বলছে যে ইরান আমাদের শত্রু নয়।’ একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার মধ্যপ্রাচ্যের বদলে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে যত ঘুরছে, সৌদি আরব ততই স্থিতিশীলতায় আগ্রহী হচ্ছে।’

গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে লেখা হয়েছে ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর পারমাণবিক চুক্তি কার্যত নষ্ট হওয়ার পর সৌদি আরবের মধ্যে ভয় ঢুকেছে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা বাড়িয়ে দেবে, এবং তার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সাথে ইরানের সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে, যার বলি হবে উপসাগরের স্থিতিশীলতা। সে কারণে, জিসিসি জোট চীন-ইরান অথনৈতিক সহযোগিতাকে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখছে যাতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে বিরত থাকে। এমনকি ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করছে জিসিসি জোট।

গত সপ্তাহেই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বৈরুতে এক সফরের সময় সাংবাদিকদের বলেছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সম্প্রতি জর্ডানে তার ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলাপ হয়েছে। ইরাকের মধ্যস্থতায় ২০১৭ সাল থেকে সৌদি ও ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যে পাঁচ দফা মুখোমুখি কথা হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন চীনও মধ্যপ্রাচ্যের বৈরি এই দু’পক্ষকে বোঝাতে চাইছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়াবে।

রাইসির সফর উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে ইচ্ছুক। ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা চায় বেইজিং।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement