২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সঙ্গীত দিয়ে চীনের সাথে তাইওয়ানের লড়াই

চীন-তাইওয়ান যুদ্ধের সময়ও শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে মেগাফোন দিয়ে চালানো হয় নানা প্রচারণা। - ছবি : বিবিসি

কল্পনা করুন এমন এক জায়গা যেখানে আপনি দিনরাত ফুল ভলিউমে গান শুনতে বাধ্য হন। একবার ভাবুন যুগের পর যুগ ধরে কাউকে এ ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হলে তার কি অবস্থা হবে।

কিময় বা কিনমেন নামে পরিচিত এক দ্বীপ থেকে কমিউনিস্ট চীনের বিরুদ্ধে প্রচারণা যুদ্ধে তাইওয়ানের সরকার এ ধরনের একটি কৌশল ব্যবহার করছে।

গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা, শত্রুপক্ষের উপকূলের দিকে তাক করে রাখা ১০ মিটার উঁচু একটি বিশাল লাউড স্পিকার দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডের শহর জিয়ামেনের বাসিন্দাদের হালকা তাইওয়ানিজ গানসহ নানা ধরনের মিউজিক শোনানো হয়, কিংবা চীনা সৈন্যদের প্রতি পক্ষ পরিবর্তন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে বক্তৃতা প্রচার করা হয়।

এটা হলো 'বেইশান রিলে ওয়াল' । যা ৪৮টি শক্তিশালী লাউড স্পিকার দিয়ে তৈরি বিশালাকৃতির একটি কংক্রিটের কাঠামো। যার আওয়াজ ২৫ কিলোমিটার দূরে, অর্থাৎ জিয়ামেনকে পর্যন্ত পৌঁছায়। অন্যদিক থেকে চীনও একই কায়দায় এর পাল্টা জবাব দেয়।

১৯৭৯ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কমিউনিস্ট চীনকে স্বীকৃতি দেয় এবং এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তিত হয় তখন পর্যন্ত অদ্ভুত এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চলছিল। এসব শব্দ দূষণে দুই তীরের বাসিন্দারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত ছোট দ্বীপপুঞ্জ চীনা উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। ১৯৪৯ সালে মাও জে দং-এর কমিউনিস্টদের হাতে চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সৈন্যরা চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ তাইওয়ানের অধীনে রয়েছে।

ওই একই বছর এই দ্বীপপুঞ্জের সৈকতগুলো বার বার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে যেখানে কমিউনিস্ট সৈন্যরা তাইওয়ান দখলের চেষ্টা করলে কুওমিনটাং সৈন্যরা তা ঠেকিয়ে দেয়। এর পর থেকে সেখানে যে স্থিতাবস্থা চলছিল তা আজও অব্যাহত রয়েছে।

তবে এরপর ১৯৫৪ এবং ১৯৫৮ সালে তাইওয়ান প্রণালী নিয়ে সংকটের সময় জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে নতুন সংঘর্ষের জায়গা হয়ে উঠেছিল এসব দ্বীপ। ওই দ্বিতীয় যুদ্ধটির পরের দু’দশক ধরে চীনা এবং তাইওয়ানিরা পর্যায়ক্রমে পরস্পরের ওপর বোমাবর্ষণ করে। কমিউনিস্টরা মাসের বেজোড় দিনে আর জাতীয়তাবাদীরা জোড় দিনে বোমাবর্ষণ করতো।

ওই সময় এসব গোলা বিনিময়ে তাজা বিস্ফোরক ব্যবহার করা হতো, যাতে বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যে আঘাত করা হতো এবং সৈন্যরা প্রাণ হারাত। কিন্তু বেশিরভাগ বোমা বোঝাই থাকতো প্রোপাগান্ডা লিফলেটে।

এসব লিফলেটে থাকতো চিয়াং কাইশেকের হাস্যোজ্জ্বল ছবি যাতে তিনি চীনা জনগণকে পক্ষ ত্যাগের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, কিংবা কমিউনিস্ট চীন থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের ছবি যারা কিময় দ্বীপের দিকে সাঁতারে আসছেন এবং এমনকি তরুণ তাইওয়ানিজদের বিয়ের উৎসবের ছবি দিয়ে বানানো স্ট্যাম্প যেগুলো জিয়ামেন শহরের আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তো।

এসব প্রচারপত্র এবং গোসলের সাবানের মতো ছোট ছোট উপহার চীনা মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দেয়া হতো বেলুনের মাধ্যমে। বাতাস যখন অনুকূল থাকতো তখন এসব ছেড়ে দেওয়া হতো কিময় থেকে। এসব বেলুনে লাগানো থাকতো টাইমার যা জিয়ামেনের আকাশে পৌঁছানোর পর সেগুলো বেলুনগুলোকে মাটিতে নামিয়ে আনতো। অথবা পাঠানো হতো বিয়ারের বোতল, যা তাইওয়ান থেকে জলে ফেলে দেয়া হতো এবং অনুকূল স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেগুলো চীনা ভূখণ্ডে পৌঁছে যেত।

১৯৬৭ সালে তাইওয়ানের ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছিল একটি নতুন অস্ত্র। আর সেটি ছিল তাইওয়ানের সবচেয়ে সুমধুর অস্ত্র, তাইওয়ানের হালকা গানের পপ তারকা তেরেসা টেং।

তিনি পরিচিত ছিলেন এশীয় পপের শাশ্বত রানী শিরোপায়। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পাশে তেরেসা টেং ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তিনি কমিউনিস্ট নেতা দেন শিয়াওপিংয়ের প্রিয় গায়িকাদের অন্যতম ছিলেন বলে জানা যায়।

বেইশা ব্রডকাস্ট ওয়াল থেকে যেসব গান বাজানো হতো তারমধ্যে তেরেসা টেং-এর কণ্ঠ ছিল বজ্রের মতো শক্তিশালী।

মারলিন ডিয়েট্রিচ বা মেরিলিন মনরোর মতো হলিউড তারকা, যারা যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করার কাজে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন, তাদের মতোই তেরেসা টেং বিশাল লাউডস্পিকারের মাধ্যমে জিয়ামেনের বাসিন্দাদের প্রতি সরাসরি বক্তব্য রাখার জন্য বেশ কয়েক বার কিময় দ্বীপে গিয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি বলতেন যে জিয়ামেনের বাসিন্দাদের সাথে দেখা করার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন, এবং স্বাধীনতাই ছিল তাইওয়ানের একমাত্র আশা।

পরের দশকগুলোতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, চীনের প্রতি এ ধরনের বার্তা পৌঁছে দেয়া এবং সঙ্গীত সম্প্রচার চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কিময় দ্বীপপুঞ্জে আরো চারটি রিলে স্টেশন তৈরি করা হয়।

তাইওয়ান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণ কোরিয়াও ২০১৮ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় তার শত্রুদের বিরুদ্ধে একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছিল। তাদের প্রতি কে-পপ ব্যান্ডের সঙ্গীত বাজিয়ে এবং প্রচার বার্তা পাঠিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

এদিকে তাইওয়ান থেকে তেরেসা টেং-এর তিয়ান মি মি (মধুর মতো মিষ্টি তোমার হাসি) গানের সুর যখন সমুদ্র পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দেয়া হতো, চীনের কমিউনিস্ট শাসকরাও তখন মূল ভূখণ্ড থেকে একই কৌশল ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এই শব্দ-যুদ্ধ দ্বীপের মানুষের জীবনকে খুব কঠিন করে তুলেছিল এবং এই দ্বীপের বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। এসব বাসিন্দাদের জন্য নীরবতা খুঁজে পাওয়া হয়ে উঠেছিল এক বিলাসিতা।

লিং মা-তেং যুদ্ধকালীন সময়ে তাইওয়ানের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন। কিময়ের ইতিহাসের ওপর তিনি পাঁচটি বই লিখেছেন।

কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, চীন থেকে আসা শব্দ আর দ্বীপ থেকে আসা শব্দ মিলেমিশে শোনা যেত বজ্রের মতো জোরে। এই শোরগোল থেকে কোনো মুক্তি ছিল না। বিরতি ছাড়াই অনবরত মিউজিক শব্দ দূষণ তৈরি করেছিল। এসব মানসিকভাবে পরিশ্রান্ত করে দিতো। যখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং তাইওয়ানের বাকি অংশ গণতন্ত্রে পরিণত হয় তখন পর্যন্ত এ ধরনের সম্প্রচার চলছিল।

এসব সঙ্গীত আজও শোনা যায়, তবে লো ভলিউমে। শত শত পর্যটক, যাদের বেশিরভাগই চীনা, যারা দ্বীপটিতে বেড়াতে যান তারা এসব উপভোগ করেন।

২০০১ সালে চীনের মূল ভূখণ্ড ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়। ওই সময় চীন সরকার যে নীতিমালা গ্রহণ করেছিল তার নাম তিন মিনি লিঙ্ক। এই নীতির আওতায় জিয়ামেনের সাথে সীমিত পরিবহন, ডাক এবং বাণিজ্যিক সংযোগ আবার চালু হয়। এরপর তাইওয়ানের দ্বীপপুঞ্জটি কৌতূহলী চীনাদের জন্য পর্যটনের এক গন্তব্য হয়ে ওঠে। দু'দেশের মধ্যে অতীত যুদ্ধের নিদর্শন, যেগুলো এখনো সৈকতে পড়ে আছে, সেগুলোর সাথে তারা ছবি তোলেন এবং দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়িগুলোতে ঘোরাঘুরি করেন।

আর এই দ্বীপে এখনো ভেসে বেড়ায় তেরেসা টেং-এর মিষ্টি কণ্ঠস্বর।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার তীব্র মাত্রায় হিংস্র হয়ে উঠেছে সরকার : মির্জা ফখরুল মিরসরাইয়ে মৃত্যুর ১৫ দিন পর ব্যাংক কর্মকর্তার কবর থেকে লাশ উত্তোলন দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং, দুর্ভোগে মানুষ রংপুরে মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করায় ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি

সকল