২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সরকার হঠাৎ ভেঙে পড়লো কেন

- ছবি - সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বগ্রাস দুর্নীতি আর ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় দেশটিকে তিলে তিলে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে এসেছিলো।

যদিও তিন বছর আগে সবার ধারণা ছিলো যে, শতভাগ শিক্ষিত মানুষের এ দেশটির অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং এর মূল ভিত্তি ছিলো পর্যটন থেকে আসা আয় যা ক্রমশ বাড়ছিলো আর রেমিটেন্স।

পেশাগত কাজে গত দুই দশকে কমপক্ষে তিনবার শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছেন সাংবাদিক তারেক মাহমুদ। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে ও পরে এসব সফরে গিয়ে দেশটি খুব দ্রুতই ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করবে বলেই ধারণা করেছিলেন তিনি।

‘মানুষজনের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি দেখে মনে হচ্ছিলো যে দক্ষিণ এশিয়া অনেকটা ইউরোপের মতো কলম্বো। একটা নাইট লাইফ আছে। ধর্মীয় বৈচিত্র্য আছে। মানুষ জীবনকে উপভোগ করতে জানে। একটা স্মুথ লাইফ। সবকিছু মিলিয়ে এমনটাই মনে হতো।’

বাস্তবতা হলো সেই শ্রীলঙ্কা এখন ধুঁকছে অর্থনৈতিক সঙ্কট আর রাজনৈতিক সহিংসতায় এবং টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়ছে দেশটির অর্থনীতি।

যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে রাজাপাকসে সরকারের একের পর এক ভুল নীতি, দুর্নীতি আর আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে।

সঙ্কটের সূত্রপাত কয়েক দশক আগে থেকেই
দাতা দেশ ও সংস্থা গুলোর ঋণ পরিশোধে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায়। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ঔষধ সঙ্কট ছাড়াও বিদ্যুৎহীনতার মধ্যেই কাটছে দিনের বেশিরভাগ সময়।

পরিস্থিতি এমন যে, বলা হচ্ছে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এমন সঙ্কটে দেশটি আর কখনো পড়েনি।

অথচ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর প্রাণ ফিরে এসেছিলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, জমজমাট হয়ে উঠছিলো পর্যটনসহ সেবা খাত। তাহলে মাত্র দুই বছরের কোভিড মহামারির পর এভাবে ভেঙে পড়লো কেন দেশটি?

কলম্বোয় সিলন চেম্বার অফ কমার্স বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজনে করেছিলো।

সেখানে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ইন্দ্রজিত কুমারস্বামী বলেছেন, শ্রীলঙ্কার এ সঙ্কট হুট করে জন্ম হয়নি বরং এ সঙ্কটের উৎসের দিকে তাকাতে হলে অনেক আগে ফিরে যেতে হবে সেই পঞ্চাশের দশকে।

তার মতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে দেশটির অর্থনীতি কখনোই নিরাপদ থাকার মতো স্থিতিশীলতা পায়নি। গত কয়েক বছরে এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত।

‘আমাদের কখনোই শৃঙ্খলাপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছিলো না। এটাই অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিক একটা উৎস ছিলো। এটা ছিলো জনতুষ্টিবাদী সস্তা রাজনীতি আর ভাগ বাটোয়ারা সংস্কৃতির একটা দূষিত সমন্বয়, যা আমাদের পেছনে ঠেলেছে। তবে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিলো। যদি একইসাথে তখন আমাদের বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, এর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ডিসিপ্লিনড হওয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু যা হয়েছে তা হলো নিয়মিত বার্ষিক বাজেট ঘাটতির কারণে রাজস্ব কমেছে নাটকীয়ভাবে। কমেছে রফতানি আর বেড়েছে ঘাটতি। তবে সমস্যাটা ব্যাপক বেড়েছে গত ১০-২০ বছরে।

কুমারাস্বামী বলছেন, আগেও বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে বারবার। আর এখন চীনের ঋণ পরিশোধ বড় সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। অন্য ঋণদাতারাও দেখছেন যে চীন এ বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে।

চীন, ঋন আর দুর্নীতি
শ্রীলঙ্কায় চীনের কিছু প্রকল্পই দেশটির সরকারকে ঋণভারে জর্জরিত করেছে- এমন অভিযোগ আছে।

বিশেষ করে হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্র বন্দর, বিলিয়ন ডলারের বিমানবন্দর বা পোর্ট সিটির মতো প্রকল্পগুলো নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিলো।

এর সাথে যোগ হয়েছিলো গোটাভায়া রাজাপাকসের সস্তা জনপ্রিয়তার স্মারক - হুট করে কর কমানোর নীতি- যার ভার পরবর্তীতে করোনার সময়ে আর সইতে পারেনি ৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা। পরে ইউক্রেন যুদ্ধ সেই সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

যার সাথে যোগ হয়েছে করোনাকালীন বাস্তবতা। যেমন প্রতি বছর কেবলমাত্র পর্যটন থেকেই শ্রীলঙ্কার পাঁচ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার আয় ছিলো।

দুই বছরের কোভিডকালে সেটি কার্যত শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে।

২০১৯ সালে কলম্বোয় যে হামলা হয়েছিলো সেটি এবং তার জেরে পরে ব্যাপক মুসলিম নিগ্রহের ঘটনাও পর্যটন ধ্বসে ভূমিকা রেখেছে।

আবার করোনার দুই বছরে রেমিটেন্স থেকে আয়ও কমে গেছে ব্যাপকভাবে।

তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকেই শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিণতির মূল কারণ হিসেবে বলছেন সিলভারাইন ডি সিলভা, যিনি এক সময় ঢাকাতেও সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। তিনি বলছেন, যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা এই দুর্নীতিকে রাজাপাকসে পরিবার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কারণেই দেশটির এই দশা।

‘আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা কিছু হয়েছে সবই ভুল। কলম্বো পোর্ট থেকে আরম্ভ করে হাম্বানটোটা বন্দর, এয়ারপোর্ট- এগুলো সবই ছিলো অর্থের অপচয়। বেশিরভাগ ঋণ এসেছে চীন থেকে। তারাই নির্মাণ করছে। এবং এখন তারা এগুলো করে যাচ্ছে।’

অথচ ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহ দমনের সাফল্যে মহানায়ক হয়ে উঠছিলো তখনকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকশা। তখন প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন তার ভাই গোটাভায়া রাজাপাকশা।

২০১৯ সালের নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর তারা দুই ভাই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পরিবার থেকেই আরো মন্ত্রী ও এমপিও রয়েছে।

সিলভারাইন ডি সিলভা বলছেন, রাজাপাকসে পরিবার প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন শুধু যুদ্ধের কারণেই নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই তাদের ওপর ভরসা করেছিলো জনগণ।

তবে এ ভরসায় আস্থা না রেখে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে কর্তৃত্বপরায়নতার দিকেই যাচ্ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকশা।

রাজাপাকসেদের হটাতে নির্বাচনের বদলে আন্দোলন কেন
শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় ধরণ থেকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি ধাঁচের করে নিয়েছিলেন। সাথে দেখা দেয় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন আর ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা।

কিন্তু তারপরেও যে দেশে ভোটের মাধ্যমেই বারবার ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে সেখানে রাজাপাকসে পরিবারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গণঅভ্যুত্থানের বা আন্দোলনের দরকার হলো কেন?

এ প্রশ্নের জবাবে কলম্বো থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জেহান গুনাতিলক বলছেন, ভয়াবহ অসন্তোষ তৈরি হওয়ার কারণেই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধৈর্য বা বাস্তবতা নেই।

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমাদের নির্বাচন নিয়মিত হচ্ছিলো এবং যথাযথ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াও ছিলো। কিন্তু আমাদের পরিবারতন্ত্র আছে। এক দশক ধরে ক্ষমতা এক পরিবারের মধ্যেই ঘুরছে। আমি মনে করি দুর্নীতি দীর্ঘকাল ধরেই বড় সমস্যা। যে কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, যার মাধ্যমে দুর্নীতি দূর হতে পারে। এর একটি পরিণতিই পেলো এবারে। আর এ জন্য মানুষ রাজপাকশা ভাইদের বিদায় এভাবেই চাইছে। মনে হয় এটাই আসল কারণ।’

তবে এখনি নির্বাচন আয়োজনে শাসনতান্ত্রিক বাধাও আছে। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০১৯ সালে আর পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে ২০২০ সালে।

দেশটির নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ ও ২৫ সালের আগে এসব নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ আড়াই বছর গেলে রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাঙ্গতে পারেন সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে। এছাড়া সংসদ নিজে প্রস্তাব পাশ করে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভাঙ্গার অনুরোধ করতে পারে।

আর রাষ্ট্রপতিকে সরাতে সংসদ অভিশংসন করাতে পারে বা তিনি নিজ ইচ্ছায় সরে যেতে পারেন। কিন্তু এর কোনো কিছুই সম্ভব হবে না কারণ এখনকার পার্লামেন্টে মাহিন্দা রাজাপাকসের দলই ব্যাপক সংখ্যাগিরষ্ঠতায় আছে।

বিরোধী দলগুলোর প্রকৃত অবস্থা কী
ড. জেহান গুনাতিলক বলছেন যে, পার্লামেন্টে বিরোধী দল এখনো ছোট। তারা এবার সঙ্কটের শুরু থেকেই অনেক সোচ্চার পার্লামেন্টে। কিন্তু মানুষ আশা করেছিলো তারা আরো সোচ্চার হবে। তারা আশা করেছিলো যে বিরোধী দল আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলবে এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের বিকল্প কি হতে পারে।

‘তবে মনে রাখতে হবে যে তারা সংখ্যায় খুবই কম যে কোনো নির্বাচন ছাড়া তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। প্রকৃত পরিবর্তন বা নতুন কাউকে আনতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমেই আনতে হবে। না হলে বিষয়গুলো এর মধ্যে এভাবেই ঘুরপাক খাবে।’

গুনাতিলক বলছেন, শুধু পরিবারতন্ত্র নয়, প্রভাবশালী দেশগুলোর শক্তি নিয়েও অনেক রাজনীতিক দেশ পরিচালনায় থাকেন যে কারণেই তাদের অনেক সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থ নষ্ট করে।

আবার যেই পরিবারতন্ত্রের জন্য রাজাপাকশা পরিবারের সমালোচনা হচ্ছে সেই পরিবারতন্ত্রেরই ফসল বিরোধী প্রধান নেতা নিজেও, যার বাবা ছিলেন রাষ্ট্রপতি।

আবার দেশটিতে প্রায় ৭০টির মতো দল থাকলেও সংসদে আছেন দশ বা এগারটি। অন্যদিকে সরকারের কর্তৃত্বপরায়নতার কারণে দেশটিতে সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম খুব একটা বিকশিত হতে পারেনি।

বিজয় থেকে সিংহলি জাতীয়তাবাদ
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর তামিলদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কা সরকারের বিজয়কে দেশে সিংহলিরা শান্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও অনেকে মনে করেন এর মাধ্যমে আসলে দেশটিতে উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছিলো, যার ফলে হিন্দু, মুসলিমসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমশ আক্রমণের টার্গেট হয়েছে।

আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিংহলিরা এখন ক্ষুব্ধ হলেও তাদের একটি অংশের সমর্থনও আছে রাজাপাকশাদের দিকেই।

আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার আইনজীবী অম্বিকা সাতকুনানাথান বলছেন, রাজনৈতিক বিরোধীরা যেমন ততটা শক্তিশালী না তেমনি সরকারের বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটিকে রাজাপাকশা সরকারের বিরুদ্ধে কখনোই তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। তবে এখন কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

‘সিভিল সোসাইটিকে আগে রাজপাকসে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে খুব একটা কথা বলতে শোনা যায়নি। তবে এখন নির্দলীয় অনেকে কথা বলছেন। আর মিডিয়াগুলোও দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া এখন অবশ্য মাঠে কি হচ্ছে তা জানানোর চেষ্টা করছে।’

তিনি বলছেন সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম কখনোই বিকশিত হতে পারেনি এবং সে কারণে এখনো অনেক যেমন চুপ থাকছেন আবার কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রেও রাজাপাকশা পরিবারের মালিকানাও রয়েছে।

তবে এখন বিশ্লেষকরা আশা করছেন দেশটির সরকারে পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছে এবং সরকার স্থিতিশীল হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও সহায়তার হাত বাড়াবে এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

যদিও এটি কবে কখন হবে সেটি দেখতে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে এ মুহূর্তে তা কারো জানা নেই।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement