১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীনা ব্লগারদের আক্রমণের শিকার পশ্চিমা বিশ্ব

- ছবি : সংগৃহীত

হাস্যোজ্জ্বল ব্লগার গুয়ানমুচান চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোর খুব পরিচিত এক মুখ। টুইটারের আদলে গড়া চীনের এই সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ওই তরুণীর ফলোয়ারের সংখ্যা ৬৪ লাখ। চলমান বিশ্বের খবরাখবরের ওপর ওয়েইবোতে তিনি নিয়মিতভাবে নিজের মন্তব্য ও ভিডিও পোস্ট করেন। কিন্তু তার ব্র্যান্ডের নরম-সরম চেহারার সাথে তিনি যেসব ঝাঁঝালো মন্তব্য করেন, তার মিল রয়েছে খুবই কম।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘কুকুরের রশি’ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে আমেরিকা, সম্প্রতি এক পোস্টে মন্তব্য করেছেন গুয়ানমুচান। আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ‘গৃহযুদ্ধের’ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ‘আমেরিকানরা জীবাণু অস্ত্র দিয়ে একে অন্যকে খুন করছে।’

চীনের একদল নতুন প্রজন্মের ব্লগার, যাদের ‘যিগানউ’ নামে ডাকা হয়। গুয়ানমুচান তাদেরই একজন। কিন্তু চীনা সোশাল মিডিয়ায় তার খ্যাতি বেড়ে যাওয়ার সাথে চীনের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রসারের একটা যোগাযোগ রয়েছে।

কাজের দিকে থেকে তার মিল রয়েছে ‘উমাও’দের সাথে। এরা হলো ভাড়া খাটা একদল কুখ্যাত ট্রল। চীনে সরকারি প্রোপাগান্ডা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এদের ব্যবহার করা হয়। তবে উমাওদের সাথে গুয়ানমুচানোর মতো ‘যিগানউ‌’র পার্থক্য হলো তিনি এসব কাজ করে থাকেন বিনামূল্যে।

এরা কঠোর মন্তব্য দিয়ে যেসব পোস্ট করেন, তাদের হাজার হাজার ফ্যান সেগুলো শেয়ার করে। এরা প্রায়শই পশ্চিমা দেশ এবং সংবাদমাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করেন। নারীবাদ, মানবাধিকার, বহু-সংস্কৃতি, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে চীনা সমাজব্যবস্থার ওপর পশ্চিমা দেশের নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এরা সেগুলোর সমালোচনা করেন।

তাইওয়ানের স্বাধীনতা কিংবা হংকংয়র গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সাথে জড়িত অধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞরাও তাদের লক্ষ্যবস্তু। ‘যিগানউ’রা যার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে তাদের একজন হলেন লেখিকা ফ্যাং ফ্যাং। উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির যে বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি সারা বিশ্বে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। কিন্তু শ্যাংডিযিইং নামে একজন ব্লগার তার সম্পর্কে লেখেন, ‘তিনি আমাদের পিঠে ছুরি মেরেছেন’ এবং ‘আমাদের ওপর কালিমা লেপন করতে চীনবিরোধী শক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন বিশাল একটি অস্ত্র।’

চীনের শীর্ষ মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ ঝ্যাং ওয়েনহংও অতি সম্প্রতি যিগানউর আক্রমণের মুখে পড়েন। তিনি শুধু বলেছিলেন যে চীনাদের কোভিডের সাথে বসবাস করা শিখতে হবে। দৃশ্যত এটা ছিল সরকারি বক্তব্যের বিপরীত। আর এ জন্যই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় সমালোচনা আর কুৎসা রটনা।

এরপর কয়েকজন ব্লগার তার একটি পুরোনো গবেষণাপত্র খুঁজে বের করে এবং অভিযোগ করে যে তিনি অন্যের লেখা থেকে চুরি করেছেন। পরে অবশ্য তার বিশ্ববিদ্যালয় এসব অভিযোগ খারিজ করে দেয়। শিশুদের নিয়মিত সকালে দুধ খাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেও তিনি বিপদে পড়েন। কারণ চীনারা সকালের নাস্তায় দুধ খায় না, এবং এটা চীনা সংস্কৃতির বিরোধী। পিনমিংওয়াশিয়াওশি নামের একজন ব্লগার তার সম্পর্কে লেখেন, ‘এটা খুব বেশি পশ্চিমা-পূজা আর বিদেশি তোষণ হয়ে যাচ্ছে নাকি?’

প্রতিদিন এধরনের ডজন ডজন পোস্ট ছাপা হয়। এসব পোস্ট সাধারণত হয় ছোট এবং আবেগপূর্ণ। আর সেজন্যই এগুলো সহজে ভাইরাল হয়ে যায়, বলছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

‘এগুলো হলো জাতীয় আবেগের ফাস্ট-ফুড,’ বলছেন চীনা সোশাল মিডিয়া বিশ্লেষক ম্যানিয়ে কেৎসে, ‘মানুষ এর এক কামড় খায়, অন্যের সাথে শেয়ার করে, এবং কিছুক্ষণ পর এর কথা বেমালুম ভুলে যায়।’

অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমা দেশের সাথে চীনের বিবাদের ফল হিসেবে বাড়ছে দেশপ্রেমী কট্টর চীনা সেন্টিমেন্ট। কিন্তু কথাটি অর্ধেক সত্যি।

বিশ্বায়নের এই যুগে বহু দেশেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চীনে এটা বেড়েছে চীনা পরিচয়কে জোরেশোরে তুলে ধরা এবং সোশাল মিডিয়ার সর্বব্যাপী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।

যিগানউদের মধ্যে অনেকেই বয়সে তরুণ। তারা বড় হয়েছেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যেখানে তাদের মাথা পরিপূর্ণ করা হয়েছে দেশপ্রেম এবং চীনা অহংকার দিয়ে, বলছেন কেৎসে। তার মতে, ফলে বিদেশবিরোধী ও চীনাপ্রীতির এক বিস্ফোরক মিশ্রণে তৈরি হয়েছে নতুন এই চীনা সংস্কৃতির পরিচয়।

চীনে অনলাইনে বক্তব্য রাখার ব্যাপারে আইন ক্রমাগতভাবে কঠোর করার পরও এসব ব্লগারের খ্যাতি অবাক করার মতো। অ্যাক্টিভিস্ট কিংবা সাধারণ নাগরিকদের কথাবার্তা চীনে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ওয়েইবো কিংবা উইচ্যাটে ‘স্পর্শকাতর’ পোস্ট নিয়মিতভাবে মুছে ফেলা হয়। কিন্তু সরকারি লাইনের বক্তব্য যারা তুলে ধরেন তাদের উৎসাহ দেয়া হয়। তাদের ব্যাপারে আইন থাকে শিথিল, বলছেন একজন পর্যবেক্ষক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ব্লগারের বক্তব্য চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমেও তুলে ধরে তা প্রচার করা হয়।

তবে সরকারের সঙ্গে এসব 'যিগানউ'র কোন সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা জানা যায় না। কিন্তু এদের অনেককেই সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রাদেশিক সরকার থেকে তাদের সম্মানসূচক খেতাব দেয়া হয়।

গুয়ানমুচানের আসল নাম শু চ্যাঙ। ‘আপনি একজন চীনা’ ২০১৪ সালে এই নিবন্ধ লিখে তিনি প্রথম সবার নজর কাড়েন। সে সময় প্রধান সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে খবর প্রচারিত হয়েছিল। এরপর থেকে ইয়নতাই পৌর কর্তৃপক্ষের আয়োজিত ব্লগার সম্মেলনে তাকে নিয়মিত দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে তরুণদের নিয়ে অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। গুয়াংডং প্রদেশের সরকার গত জুলাই মাসে কয়েকজন ব্লগারকে 'ইন্টারনেট দূত' খেতাব দিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তার নামও রয়েছে।

বিবিসির পক্ষ থেকে তার কাছে কিছু প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি।

নির্ভরশীলতার সম্পর্ক
চীনের ইন্টারনেট দুনিয়ার জটিল সম্পর্কের মধ্যে যিগানউ মাত্র একটি অংশ। দেশটির সোশাল মিডিয়ায় দেশপ্রেম সম্পর্কিত যেসব কথাবার্তা হয় তা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে প্রধান কয়েকটি সরকারি সংবাদমাধ্যম। তারা যেমন একটি হ্যাশট্যাগ তৈরি করে দেশব্যাপী আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে, একই সাথে সেই আলোচনা কোন দিকে এগুবে তাও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এদের বাইরেও রয়েছে বহু ছোট ছোট গ্রুপ, ডিজিটাল আর্টিস্ট, ছোট মিডিয়া কোম্পানি, শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ও এমনকি বিদেশী ভ্লগার পর্যন্ত। এরা সবাই একযোগে সরকারের দেয়া আগুনে হাওয়া দেয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডাবলথিংক ল্যাবের একজন বিশ্লেষক হারপ্রি কে বলছেন, শাসক কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে যারা প্রচারণা চালায় চীনের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রকরা তাদের খুব উৎসাহ দিয়ে থাকে।

এখানে আপনাকে সুযোগ সন্ধানী হতে হবে, বলছেন তিনি। তার মতে, আপনি যদি সোশাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী হতে চান। তাহলে কট্টর জাতীয়তাবাদী এই পরিবেশের মধ্যে থেকেই আপনাকে খ্যাতি অর্জন করতে হবে। তবে এসব সোশাল ইনফ্লুয়েন্সাররা সরাসরিভাবে সরকারের পয়সায় না চললেও জাতীয় সংবাদমাধ্যমের কাঁধে ভর করে এরা বেড়ে ওঠেন এবং সেই স্বীকৃতিকে বিক্রি করে তারা তাদের ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডের পরিচিতিকে বাড়িয়ে তোলেন, বলছেন বিশ্লেষকরা।

ভক্ত সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের সাইটের বিজ্ঞাপন এবং পেইড কন্টেন্ট থেকে এরা বহু অর্থ আয় করেন। সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ক শিক্ষক ড. ফ্যাং কেচেং জানাচ্ছেন, ১০ লাখ ফলোয়ার রয়েছেন এমন কারও সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে কয়েক লক্ষ ডলার আয় হয়।

এর বদলে চীনা সরকারেরও লাভ হয়। যেমন, যিগানউদের কোন বিষয়ে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানিয়ে সরকার মূলত তাদের দিয়ে আদর্শিক প্রচার চালায়। ফলে একজন ব্লগার নিজে যেমন বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। একই সাথে প্রোপাগান্ডা চালানোর কাজে তিনি হয়ে উঠেন একজন রোল মডেল বা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, বলছেন ড. ফ্যাং।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যারা বেশি অনুগত ওয়েইবো এবং উইচ্যাটের মত সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি তাদের পোস্টকে বেশি বেশি তুলে ধরে, বলছেন তিনি। এতে তাদেরও লাভ হয়। সোশাল পোস্টের এনগেজমেন্ট এবং ইউজার অ্যাক্টিভিটি বেড়ে গেলে তারা আরও বেশি অর্থ মুনাফা করে। ফলে এটা তাদের জন্য এক লাভজনক কৌশল। তবে চীনের সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের পথ চলতে হয় অত্যন্ত সরু সূতার ওপর ভর করে। কখনও কখনও তারা কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।

গত ক‌য় মাসে ঝ্যাং ওয়েনহংকে আক্রমণ করেছিলেন যারা এবং কোভিড যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে, এমন কথা প্রচার করেছিলেন যে ক'জন 'যিগানউ' তাদের সে সব পোস্ট মুছে ফেলা হয়। চীনে কঠোর কমিউনিস্ট সংস্কারের ওপর আবেগপূর্ণ এক লেখা অনলাইনে ছাপা হওয়ার পর তা নিয়ে প্রবল হৈচৈ শুরু হলে সেটিও সেন্সর করা হয়।

‘আপনি কী করতে পারবেন, আর পারবেন না, তার নিয়মনীতি বেশ ঘোলাটে,’ বলছেন মিস কেৎসে, ‘ওয়েইবোতে একটি পোস্ট দিয়ে একজন ব্লগার অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। সরকারি বক্তব্য প্রচারে এরা সহায়ক হলেও যে মুহূর্তে দেখা যাবে কাউকে দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না কিংবা সরকার মনে করবে সে সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তখন সাথে সাথেই তাকে বিদায় নিতে হবে।’

তবে চীনে এই জুয়া খেলতে রাজি অনেকেই। গত সেপ্টেম্বরে গুয়ানমুচানকে ওয়েইবো থেকে ১৫ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয়েছিল, তিনি সামাজিক যোগাযোগের নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু সাথে সাথে তিনি আরেকটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তার প্রতিদিনের পোস্টের ধারা চালিয়ে যেতে থাকেন। ‘এই ছোট অ্যাকাউন্টটি আমি আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম যদি কখনো কিছু একটা ঘটে যায়,’ লিখেছেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল