২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উত্তর কোরিয়ায় তীব্র খাদ্য সঙ্কট, কেন?

-

উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেক মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। এখন দেশটির নেতা কিম জং উন সামনে মারাত্মক খাদ্য সঙ্কট হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়া যেরকম কঠোর গোপনীয়তায় ঢাকা এক রাষ্ট্র, সেখান থেকে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন। উত্তর কোরিয়ার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু জানা যাচ্ছে এ বছর পরিস্থিতি তীব্র সঙ্কট দেখা দিতে পারে। কিন্তু কেন?

উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য মূল্যের কী অবস্থা?
দেশটিতে যে খাদ্যের সঙ্কট তৈরি হয়েছে তার সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায়। এক কিলোগ্রাম (কেজি) ভুট্টার দাম গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩৭ ওয়ানে (প্রায় দুই মার্কিন ডলার)। এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ডেইলি এনকে ওয়েবসাইট থেকে, যারা উত্তর কোরিয়ায় তাদের বিভিন্ন সূত্র হতে এসব সংগ্রহ করে।

উত্তর কোরিয়ায় ভুট্টার দামের গ্রাফ
এশিয়া প্রেস ওয়েবসাইটের খবর অনুযায়ী, এরপর আবারো প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম দ্রুত বাড়তে থাকে জুনের মাঝামাঝি। এই ওয়েবসাইটটি উত্তর কোরিয়ার মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে পাচার করা কিছু ফোনের মাধ্যমে।

উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভুট্টার চেয়ে ভাত বেশি পছন্দ করে। কিন্তু তারপরও তারা ভুট্টা বেশি খায়। কারণ এটি দামে সস্তা। এদিকে চালের দামও বেড়ে গেছে। দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে চালের দাম বেশ উঠানামা করে।

উত্তর কোরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বেনজামিন সিলবারস্টাইন বলেন, উত্তর কোরিয়ার বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমেই দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য পাওয়া যায়। কারণ উত্তর কোরিয়ার মানুষ বাজারে গিয়ে লেন-দেনের মাধ্যমেই তাদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনে।

তিনি আরো বলেন, সরকারি কর্মচারীদের একেবারে ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকে।

সরকার যে রেশন দেয়, তা আসলে বেশিরভাগ পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আর বড় বড় নগরী থেকে যারা দূরে তাদের জন্য তো এই রেশন মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। এর মানে হচ্ছে, বহু মানুষই তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে রাস্তার ধারে বসা অবৈধ বাজারের ওপর নির্ভর করে।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফসলের ক্ষতি
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন খাদ্য সঙ্কট সম্পর্কে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি গত বছর টাইফুন (ঘূর্ণিঝড়) ও বন্যায় ফসলের ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন।

প্যারিস-ভিত্তিক কৃষি পর্যবেক্ষণ সংস্থা জিওগ্লামের হিসাবে ১৯৮১ সালের পর গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

একের পর এক টাইফুন আঘাত হেনেছে কোরিয়ান উপদ্বীপে। এর মধ্যে তিনটি টাইফুন উপকূলে আঘাত হেনেছিল গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে। উত্তর কোরিয়ায় এই সময়টি ছিল ধান ও ভুট্টার ফসল তোলার মৌসুম।

চলতি জুন মাসের শেষ নাগাদ দেশটিতে খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ আগের বছরের শরৎকালের ফসল থেকে সরকার যে খাদ্য মওজুদ গড়ে তোলে, তা এতদিনে প্রায় ফুরিয়ে গেছে। গত বছরের আগস্টের শুরুতে টাইফুন 'হাগুপিট' আঘাত হেনেছিল। এটি ছিল এমন একটি দুর্যোগ, যেটির ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, বন্যায় ৪০ হাজার হেক্টর (এক লাখ একর) ক্ষেতের ফসল বন্যায় নষ্ট হয়েছে ও ১৬ হাজার ৬৮০টি ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। তবে এরপর আরো যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে, ওইগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

উত্তর কোরিয়ায় কয়েক দশক ধরে যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে, তার ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি আরো বেশি করে হচ্ছে।

১৯৯০-এর দশকে দেশটিতে যখন তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তখন জ্বালানির জন্য ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস করে গাছ কাটা হয়েছে। এরপর নিয়মিত বৃক্ষ রোপণ অভিযান চালানো হলেও বনাঞ্চল উজাড় অব্যাহত রয়েছে, যা বন্যার ভয়াবহতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের গত মার্চে প্রকাশ করা এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়ায় ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর বন উজাড় করা হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমির গাছপালা।

উত্তর কোরিয়াবিষয়ক একটি ব্লগ ৩৮ নর্থের হিসাবে, দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যদিও কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তারপরও এটি এখনো অনেক অপর্যাপ্ত।

সারের তীব্র সঙ্কট
উত্তর কোরিয়ার কৃষি খাতের যে সমস্যাটির কথা খুব কম জানা যায়, সেটি হচ্ছে সারের সঙ্কট। সেখানে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সার জোগাড় করা খুবই কঠিন। ২০১৪ সালে কিম জং উন এক চিঠিতে কৃষি খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা যেন বিকল্প হিসেবে সহজে পাওয়া যায় এমন সারের উৎস খুঁজে বের করেন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কেসিএনএর প্রকাশ করা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, সব ধরনের গোবর ব্যবহার করুন, যেমন গৃহপালিত পশুর গোবর, মানুষের মল ও গোবর সার এবং খাদের তলার মাটি।

নিকেই এশিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, উত্তর কোরিয়া সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দেশটির একটি প্রধান সার কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে। আর এই যন্ত্রাংশ যে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার জন্য দোষারোপ করা হচ্ছিল কোভিডকে। কোভিডের কারণে দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীনের সাথে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়।

নিষেধাজ্ঞার কারণে উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্য খুবই সীমিত
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। এ কারণে চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের সাথে তাদের বাণিজ্য হয় একেবারেই সীমিত আকারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন হতে উত্তর কোরিয়ায় মোট রফতানির পরিমাণ ছিল আড়াইশ’ কোটি ডলার থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি ডলার। কিন্তু চীনের শুল্ক দফতরের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ডলারের নিচে।

উত্তর কোরিয়া ও চীনের সীমান্তের দুই পাশের যেসব স্যাটেলাইট ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে সীমান্তের দুই দিকে (সিনিইজু ও ডানডংয়ের কাছে) ২০১৯ সালের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, বাণিজ্যের জন্য এই সীমান্ত সম্ভবত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এই সংস্থার গবেষকরা যেখানে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সীমান্তের কাছে একশ’র বেশি গাড়ি দেখেছিলেন, তার তুলনায় ২০২১ সালের মার্চ মাসে সেখানে ছিল মাত্র ১৫টি গাড়ি। তবে মার্চ মাসে আগের তুলনায় অনেক বেশি রেলের বগি দেখা গেছে একই স্থানের আগের দুই বছরের তুলনায়। এ থেকে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন যে আরো বাণিজ্য হয়তো শুরু হবে। তবে উত্তর কোরিয়ার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যে সীমান্ত খুব শিগগিরই খুলে দেয়া হবে।

খাদ্য ত্রাণ নিয়ে সমস্যা
সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ায় উত্তর কোরিয়ার খাদ্য ত্রাণ পেতেও সমস্যা হচ্ছে। এই খাদ্য ত্রাণ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে। জাতিসঙ্ঘ বলছে, গত দশকে দাতা দেশগুলো থেকে উত্তর কোরিয়ায় যথেষ্ট ত্রাণ সাহায্য যায়নি।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার প্রায় দুই থেকে তিন মাসের সরবরাহের পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, যদি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি ও খাদ্য ত্রাণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো না হয়, তাহলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার পরিবারগুলো খুবই কঠিন এক মঙ্গার মুখোমুখি হবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement