২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিদেশী সেনারা চলে যাবার পর বিপদে আফগান দোভাষীরা, মৃত্যুর শঙ্কা

আফগানিস্তানে জীবন নিয়ে শঙ্কিত বিদেশী বাহিনীর সহযোগী হয়ে কাজ করা লোকজন। - ছবি : সংগৃহীত

২০১৩ সালের দিকে তাজিক মোহাম্মেদ তার ছুটি কাটাচ্ছিলেন তার সবুজ-শ্যামল চমৎকার গ্রামে। কাপিসাতে তার ছোট বাগান ঘেরা বাড়িতে এমন আনন্দঘন সময় কাটানোর সময়ই তিনি জানতে পারেন যে তিনি এখন তালেবানের কালো তালিকাভুক্ত। তার অপরাধ? তিনি মার্কিন সেনাদের জন্য দোভাষীর কাজ করেছেন।

রাতের অন্ধকারেই এ হাইস্কুল পাশ দোভাষীকে পালাতে হয়েছে ১১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের দক্ষিণাঞ্চলে। এরপর থেকে তিনি এখানেই আছেন। তার পরিবারও এখন তার কাছে চলে এসেছে। কারণ, তিনি বাড়িতে আছেন মনে করে তার বাড়িতে হ্যান্ড গ্রেনেড (বিস্ফোরক বোমা) ছুঁড়েছিল তালেবান সদস্যরা।

তাজিক মোহাম্মেদ (৩২) মার্কিন বাহিনীর হয়ে অশান্ত গজনি প্রদেশে কাজ করেছেন। এ শহরটি এক প্রধান মহাসড়কে অবস্থান করছে যেটা তালেবানের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলের দিকে চলে গেছে।

পরবর্তীকালে তিনি তার দোভাষীর চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। সময় মতো তিনি তার কাজে ফিরতে না পারায় তার চাকরি চলে যায়। তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেন যে যদি তিনি ওই সময় সড়কপথে কর্মস্থলে যেতেন তবে তালেবান সদস্যরা তাকে হত্যা করত।

তিনি ও তার মতো আরো হাজারো ব্যক্তি এখন মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে বেঁচে আছেন। কারণ, এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন যে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিনি সকল মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনবেন। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে আলকায়েদার হামলার ২০ বছর পর তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন।

পহেলা মে তারিখ থেকে মার্কিন বাহিনী, ন্যাটো ও বিদেশী সামরিক ঠিকাদারারা তাদের দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তারা ফেলে রেখে গেছেন তাদের সাথে কাজ করা দোভাষী, ক্লিনার, পাচক ও দারোয়ানদের। তাদের বেশিরভাগই এখন মৃত্যুর আশঙ্কায় ভীত। তারা ভয় পাচ্ছেন যে তাদেরকে সাধারণ আফগান ও তালেবানের প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে তালেবান ও আশরাফ গনি নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টির। কিন্তু, গত বছর কাতার আলোচনার পরও এ ধরনের প্রচেষ্টায় কোনো ভালো ফল মেলেনি।

এদিকে তালেবান বলছে, তারা বিদেশী বাহিনীগুলোর সাবেক চাকরিজীবীদের শত্রু বলে মনে করে না। কিন্তু এ সকল কর্মচারীদের অনুশোচনা করা দরকার। তবে, এ সকল লোকদের উচিৎ হবে না প্রাণ আশঙ্কার অজুহাত দেখিয়ে বিদেশে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করা।

তাজিক মোহাম্মেদ অবশ্য তালেবানের এ আশ্বাসে বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, ‘অতীতে তালেবান প্রচার করেছিল যে কেউ যদি বিদেশী বাহিনীর জন্য একদিনও কাজ করে তবুও তাকে হত্যা করা বৈধ। আমি তালেবানের কথায় বিশ্বাস করি না। তারা বহু সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের লোকদের হত্যা করেছে। তারা আমাদের নিরাপত্তার কোনো দায় নিতে চায় না। আমরা আমাদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলে বিদেশী সেনাদের জন্য কাজ করেছি, এখন তারা আমাদের ঝুঁকির মধ্যে রেখে চলে যাচ্ছেন। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, আমরা আবার প্রাণ হারানো শঙ্কায় আছি। তারা দাবি করেন, তাদেরকেও বিদেশে নিয়ে যাওয়া হোক। যাতে করে তারা নিরাপদে থাকতে পারেন।

এদিকে বিদেশী বাহিনীগুলোর সাবেক চাকরিজীবীরা একটি সমিতি গঠন করেছেন তার নাম ‘দ্য আফগান লেফট বিহাইন্ড অ্যাসোসিয়েসন’ (আলবা)। এ সমিতির দু’হাজার সদস্য। তারা তাদের দাবিগুলো তুলে ধরছেন ও সচেতনতা গড়ে তুলছেন এ সমিতির মাধ্যমে। তারা বলছেন, ন্যাটো সদস্যরা চলে গেলে তাদের টার্গেট করে হত্যা করা হবে।

গত সপ্তাহে এ আলবা সদস্যরা কাবুলে সমাবেশ করেন। তারা তাদের মুখ ভালোভাবে ঢেকে রেখেছিলেন যাতে করে কেউ তাদের চিনতে না পারে। এ সময় অনেক দোভাষী ও বিদেশী বাহিনীগুলোর সাবেক চাকরিজীবীরা ওই সমাবেশে উপস্থিত হন।

নো ওয়ান লেফট বিহাইন্ড নামের এক মার্কিন অলাভজনক সংস্থা তাদের এসব দাবির পক্ষে বলেন, ‘মার্কিন মিডিয়ার তথ্য মতে, ২০১৪ সাল থেকে তিন শ’র বেশি দোভাষী ও তাদের আত্মীয় নিহত হয়েছেন।’

ওমিদ মাহমুদি আলবা সমিতির প্রেস অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সোহাইল পারদিস নামের তাদের আলবা সমিতির এক সদস্যকে পাকিস্তান বর্ডারের কাছে আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে হত্যা করা হয়েছে।

আরেকজন দোভাষী বলেন, তিনি কাবুল থেকে তার নিজের প্রদেশ নানগানহার চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তিনি টেলিফোনে সব সময় এ হুমকি পেতেন যে তুমি এক ধর্মত্যাগী, তোমাকে হত্যা করা হবে।

মোহাম্মেদ বসির নামের এক দোভাষী বলেন, আমি ফ্রান্সের বাহিনীর জন্য কাজ করেছি। তালেবান আমাকে পেলেই হত্যা করবে। কারণ, আমাকে সবাই চেনে, আমি টিভিতেও দোভাষীর কাজ করেছি।

ন্যাটো বাহিনীর হয়ে কাজ করা ও বর্তমানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আখতার মোহাম্মেদ সিরাজি বলেন, ‘তালেবানের সাধারণ ক্ষমার কথা আমি শুনেছি। কিন্তু আমি তালেবানকে বিশ্বাস করি না। কারণ, তালেবানের মধ্যে নানা আদর্শের লোক আছে। তারা দোভাষীদের পেলে ছাড়বে না।’

মার্কিন বাহিনীর হয়ে বিভিন্ন প্রদেশে কাজ করা আয়াজুদ্দিন হিলাল বলেন, ‘দোভাষীরা কোনো বিয়ে বা দাফন-কাফনের মতো ধর্মীয় কাজে যোগ দিতে পারছেন না। তারা যেখানে বাস করেন সেখানেও তারা নিরাপদ না। সাধারণ আফগানরা তাদের সাথে ভালো আচরণ করেন না। তাদের অপরাধ তারা বিদেশী সেনাদের হয়ে কাজ করেছেন।’

তিনি তার এক বন্ধুর কথা তুলে ধরেন যিনি আফগানিস্তান ছাড়তে চেয়েছিলেন নিরাপত্তাহীনতার জন্য। কিন্তু, নানগানহার প্রদেশে তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়।

আয়াজুদ্দিন হিলাল আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি আশা করি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য ন্যাটো দেশগুলোর রাজনীতিবিদরা আমাদের (দোভাষীদের) ভাগ্য নির্ধারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন।’

সূত্র : আরব নিউজ


আরো সংবাদ



premium cement