২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চীনের নব্যধনীরা যেভাবে নাকাল সোশ্যাল মিডিয়ায়

চীনের নব্যধনীরা যেভাবে নাকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় - ছবি- সংগৃহীত

একজন মানুষের সারাদিনের খাবারের জন্য কি ৬৫০ ইউয়ান বা ১০১ ডলার যথেষ্ট? সু মাংয়ের মতে, এটা যথেষ্ট নয়। তিনি 'হারপার বাজার' ম্যাগাজিনের চীনা সংস্করণের প্রধান সম্পাদক। চীনের এক রিয়েলিটি টিভি শোতে যখন তিনি এই মন্তব্য করলেন, এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করল। চীনের যে রিয়েলিটি টিভি শোতে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন তার নাম ‘ফিফটি কিলোমিটার তাওহুয়াউ’। শোতে ১৫ জন সেলেব্রিটিকে একসাথে ২১ দিন বসবাস করতে হয়।

সু মাং সেখানে বলেছিলেন, ‘আমাদের ভালোভাবে খেতে হয়। আমরা এত নিম্নমানের খাবার-দাবার খেতে পারি না।’

তার এই মন্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানান। অনেকেই উল্লেখ করেন, তাদের প্রতিদিনের খাবার খরচ চীনা মুদ্রায় ৩০ ইউয়ানেরও কম।

চীনে সু মাং এমন এক ফ্যাশন সচেতন নারী হিসেবে পরিচিত, যার পছন্দের ব্রান্ড হচ্ছে প্রাডা। সমালোচনার মুখে তিনি অবশ্য বলার চেষ্টা করেন, তাকে মানুষ ভুল বুঝেছে। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন যে পুরো সময়টা তিনি এই টিভি শোতে থাকবেন, সেই ২১ দিনের জন্যই ৬৫০ ইউয়ান খাবার খরচের কথা তিনি বলতে চেয়েছেন। কিন্তু তার এই ব্যাখ্যা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

চীনা মাইক্রোব্লগিং সাইট ওয়েইবুতে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘তিনি তার মতো করে কথাটার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, সেলেব্রিটিরা যে নিজেদের কতটা অভিজাত মনে করেন, তা তারা নিজেরাও জানেন না।’

চীনে যেসব খ্যাতিমান লোকজন নিজেদের অর্থ-বিত্ত দেখিয়ে বেড়ান, তাদের ব্যাপারে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সু মাংয়ের মন্তব্যকে ঘিরে এই বিতর্ক তার সর্বশেষ উদাহরণ।

চীনের বিশাল টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন জাংফের ছোট মেয়ে আনাবেল ইয়াওর এক মন্তব্যকে ঘিরেও এ বছরের শুরুতে একইরকম ক্ষোভের প্রকাশ দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আনাবেল ইয়াও দাবি করেছিলেন, তাকে জীবন সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে।

১৭ মিনিটের এক চোখ ধাঁধানো ভিডিও ডকুমেন্টারিতে তার সঙ্গীত কেরিয়ার তুলে ধরা হয়েছিল। আর ওই অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ‘আমি নিজেকে কখনো তথাকথিত 'প্রিন্সেস' বলে গণ্য করিনি...। আমার বয়সের আর সব মানুষের মতো আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে, যাতে আমি একটা ভালো স্কুলে যেতে পারি।’

এই ভিডিও তিনি আবার তার ওয়েইবু একাউন্টে শেয়ার করেন। ২৩ বছর বয়সী আনাবেলের বাবার সম্পদের পরিমাণ ১৪০ কোটি ডলার বলে ধারণা করা হয়। তিনি সেখানে আরো বলেছিলেন, একটি বিনোদন কোম্পানির সাথে তিনি একটি চুক্তি করেছেন, ওটাই জন্মদিনে তিনি নিজেকে নিজে উপহার হিসেবে দিয়েছেন।

'এত ধন-সম্পদের যোগ্য নয়'
চীনের ধনী লোকজন বহু বছর ধরেই তাদের অর্থ-বিত্তের জাঁকালো প্রদর্শনী চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নামিদামি গাড়ি থেকে শুরু করে হ্যান্ডব্যাগ অনলাইনে এর কোনো কিছু নিয়েই তারা বড়াই করতে কুণ্ঠিত নন। তাদের অনলাইন যারা ফলো করেন, এসব দেখে তাদের ঈর্ষা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এখন এরকম অর্থ-বিত্তের নগ্ন প্রদর্শনী, সেটা ইচ্ছেকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক- মানুষ এখন ভালোভাবে নিচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা বাড়ছে।

সু ও ইয়াওয়ের মতো সেলেব্রিটিরা এখন অনলাইনে মানুষের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। কারণ অনেকেই মনে করেন, এদের মতো সেলেব্রিটি ও ধনী লোকজনের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের আসলে এত আকাশ ছোঁয়া ধন-সম্পদ পাওয়ার উপযুক্ত নন।

চীনের গণমাধ্যম সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়ান শু।
তিনি বলেন, ‘এরকম তারকাদের সহজ কাজের সাথে তুলনা করে মানুষ অভিযোগ করবে তাদের কীরকম গাধার খাটুনি খাটতে হয়, আর তাদের উপার্জন কত কম।’

মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক ড. হাইকিং ইয়ু বলছেন, ‘সু মাং তার প্রতিদিনের খাবার খরচ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা যে লোকজনকে এতটা ক্ষুব্ধ করেছে তার কারণ আছে। কারণ চীন যে বিষয়টা ঢেকে রাখতে চাইছে, এই মন্তব্যের ভেতর দিয়ে সেই আবরণ আসলে খসে পড়ছে। চীনে আসলে কিছু লোকের হাতে অনেক বেশি সম্পদ। আর অনেক মানুষকে প্রকৃতপক্ষে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হচ্ছে।’

চীনে সম্পদের যে বৈষম্য তা আঁতকে ওঠার মতো। চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির মানুষের গড় আয় হচ্ছে ৩২ হাজার ১৮৯ ইউয়ান বা পাঁচ হাজার ৩০ ডলার। অন্য দিকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিলিওনেয়ারের বাস বেইজিং নগরীতে। বিশ্বের আর কোনো নগরীতে এত শত কোটিপতি নেই।

বিশ্বের ধনী লোকদের সম্পদের খোঁজখবর রাখে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীনের ধনীদের অর্জন করা সম্পদের পরিমাণ ছিল দেড় ট্রিলিয়ন ডলার (দেড় লাখ কোটি ডলার)। এটি যুক্তরাজ্যের জিডিপির প্রায় অর্ধেক।

ধনী লোকজন যখন তাদের ধন-সম্পদ নিয়ে বড়াই করে, এটাকে সাধারণত তাদের সংবেদনশীলতার অভাব বলে ধরা হয়। যেসব দেশে ধন-বৈষম্য খুব বেশি, সেখানে এটা বেশ চোখে পড়ে। কিন্তু চীনের বেলায় যেন এটা আরো বিশ্রীরকমের চোখে পড়ে।

চীনের সাবেক নেতা দেং শিয়াওপিং বলেছিলেন, তাদের অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য সমৃদ্ধি অর্জন করা, তাতে হয়তো কিছু মানুষ বা কিছু অঞ্চল আগেভাগে ধনী হয়ে যাবে। বহু বছর যাবত লোকে দেং শিয়াওপিংয়ের এই কথা বিশ্বাস করেছে, একদিন তাদেরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। কিন্তু বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার ৪০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, অন্যরা কেবলই পিছিয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে এমন একটা বোধ তৈরি হচ্ছে যে তারা ক্ষমতাহীন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, অনেক সময় মানুষের এই ক্ষোভ আরো বেড়ে যায় যখন তারা দেখে যে খ্যাতিমান লোকজনের কাছে যা তারা প্রত্যাশা করে, তারা সেটা করছে না। লোকজন চায়, খ্যাতিমানদের যে খ্যাতি ও প্রতীকী ক্ষমতা, সেটা তারা সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখার কাজে ব্যবহার করুক। যেমন গত মাসে যখন প্রকাশ পেল যে অভিনেত্রী ঝেং শুয়াংকে একটি টিভি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রতিদিন দুই লাখ ইউয়ান করে দেয়া হয়। তখন সেটাও তীব্র ক্ষোভ তৈরি করল। ওই পুরো টিভি অনুষ্ঠানের জন্য তাকে দেয়া হবে ১৬ কোটি ইউয়ান।

এই খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন ওয়েইবুতে লিখলেন, ‘১৬ কোটি ইউয়ানের মানে কী? একজন সাধারণ চাকরিজীবী, যিনি মাসে ছয় হাজার ইউয়ান বেতন পান, তাকে এই পরিমাণ অর্থ পেতে হলে একটানা দুই হাজার ২২২ বছর কাজ করতে হবে।

তবে ঝেংয়ের বেলায় মানুষ যেন আরো বেশি ক্ষিপ্ত ছিল। কারণ তাকে নিয়ে বিতর্ক চলছিল আগে থেকেই। এ বছরের শুরুতে তিনি সারোগেসি মাতৃত্ব নিয়ে এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। চীনে সারোগেসি (অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া করে নিজ সন্তানের জন্ম দেয়া) নিষিদ্ধ। অভিনেত্রী ঝেংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি বিদেশে অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া করে যে দুই সন্তান নিয়েছিলেন, তাদের তিনি পরিত্যাগ করেছেন।

বিপুল অর্থ উপার্জন করছেন এরকম একজন মানুষ যখন ভালো 'রোল মডেল' বা আদর্শ হতে পারছেন না, তখন তা খুবই বড় একটা সমস্যা। ঠিক এই একই কারণে ২০১৮ সালে চীনের আরেক বড় তারকা ফ্যান বিংবিংকে যখন কর ফাঁকির অভিযোগে গৃহবন্দী করা হয়েছিল, তখন তার প্রতি খুব কম সহানুভূতিই দেখা গেছে। অথচ এই অভিনেত্রী চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের একজন।

ছদ্ম বিনয়ের কৌশল
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধন-সম্পদ নিয়ে এসব নির্লজ্জ বড়াই যে মানুষ পছন্দ করে না, তার একটা কারণ এটি মূলত সাংস্কৃতিক দৈন্য প্রকাশ করে। চীনে মধ্যবিত্তে বিকাশ যত ঘটছে, ততই শহুরে শিক্ষিত মানুষ 'বিত্ত-বৈভবের প্রদর্শনী'কে অপরিশীলিত ও নিচু জাতের' কাজ বলে বিবেচনা করছে বলে মনে করেন ড. জন ওসবুর্গ। তিনি চীনের নব্য ধনীদের জীবনযাপন ওি নৈতিকতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, যারা এরকম ধন-সম্পদ দেখিয়ে বড়াই করতে চায়, তারা আসলে সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চীনে বিলাস সামগ্রীর চাহিদা কিন্তু কমছে না।

একটি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের হিসেবে চীন এখন পুরো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত বিলাস সামগ্রীর সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ সেখানে বিলাস সামগ্রীর বিক্রি করোনাভাইরাস মহামারী পূর্বের পর্যায়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ড. ইয়ু বলছেন, ধনী লোকজন তাদের সাফল্যের বড়াই করার ক্ষেত্রে এখন কিছু নতুন কৌশল নিচ্ছে। হাম্বলব্র্যাগিং বা বিনয়ের সাথে বড়াই করার ব্যাপারটা চীনে এখন রীতিমত একটা নতুন সামাজিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ছবি দিয়ে বা দামিদামি জিনিসপত্র দেখিয়ে বড়াই করার পরিবর্তে অনেক ধনী লোকজন এখন এরকম কৌশলে কাজটা করে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান

সকল