২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাভাইরাস : ভারতে চরম এই দুর্দশা তৈরি হলো কীভাবে

করোনাভাইরাসে ভারতে চরম দুর্দশা - ছবি সংগৃহীত

ভারতে বুধবারের সরকারি হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৩ হাজার ৭৮০ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যা আরো একটি নতুন রেকর্ড। কারোরই এখন সন্দেহ নেই যে বেসরকারি হিসাবে এ সাংখ্যা অনেক বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে গত এক সপ্তাহে মোট করোনা সংক্রমণের প্রায় অর্ধেকই হয়েছে ভারতে। এ সময় বিশ্বে যত করোনা রোগী মারা গেছে তার ২৫ শতাংশই হয়েছে ভারতে।

রাজধানী দিল্লিসহ বহু জায়গা থেকে হাসপাতালে অক্সিজেনের সঙ্কটের খবর এখনো আসছে। ডাক্তাররা খোলাখুলি তাদের অসহায়ত্বের কথা বলছেন। বিরোধী দলগুলো নতুন করে দেশজুড়ে লকডাউন দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে।

পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে একের পর এক উচ্চ আদালত করোনা সামাল দিতে সরকারের ব্যবস্থাপনাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করছে, নির্দেশনা দিচ্ছে।

মঙ্গলবার এলাহাবাদ হাইকোর্ট মন্তব্য করেছে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু ঘটার মতো পরিস্থিতি একটি ‘অপরাধ’ এবং ‘গণহত্যার চেয়ে তা কম নয়।’ সরকারের কাছে অক্সিজেনের এই সঙ্কটের ব্যাখ্যা চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

কিন্তু এই চরম দুরবস্থার মধ্যে ভারত পড়লো কীভাবে? ভুল কোথায় হয়েছে?

সরকারের মধ্যে এই আত্ম-জিজ্ঞাসা বা আত্ম-সমালোচনার কোনো লক্ষণ এখনো চোখে পড়ছে না।

সোমবারও ভারতের সিনিয়র একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে জোর গলায় দাবি করেন যে দিল্লি বা দেশের কোথাও অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পীযুষ গয়াল বলেন, ‘অক্সিজেনের কোনো কমতি নেই, শুধু পরিবহনে কিছু সমস্যা হচ্ছে।’

দিল্লির যে জায়গায় বসে যখন তিনি একথা বলছিলেন সে সময় তার মাত্র কয়েক মাইল দূরে কয়েকটি ছোট হাসপাতাল এসওএস বার্তা পাঠাচ্ছিল যে তাদের অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে এবং অনেক রোগীর জীবন হুমকির সামনে।

তেমন একটি হাসপাতালের উদ্বিগ্ন একজন চিকিৎসক বলেন, ‘বিশেষ করে শিশুদের জীবন নিয়ে ভয়ে আমাদের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে।’ একজন স্থানীয় রাজনীতিকের চেষ্টায় ও হাসপাতালে শেষ সময়ে কিছু অক্সিজেন পৌঁছায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সিজেনের সঙ্কট পুরো সমস্যার একটি মাত্র দিক কিন্তু তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলো প্রস্তুত ছিল না।

একের পর এক হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য
কিন্তু অনেক আগে থেকেই বার বার এর জন্য সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। যেমন, গত বছর নভেম্বরে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটি সরকারকে সতর্ক করে যে অক্সিজেনের যথেষ্ট মজুদ নেই এবং হাসপাতাল বেডের বড় সঙ্কট রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে আরেক দফা ‘কোভিড সুনামি’র সম্ভাবনা নিয়ে তারা শঙ্কিত।

মার্চের শুরুর দিকে সরকারের তৈরি বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি সতর্ক করে যে করোনাভাইরাসের অধিকতর সংক্রামক একটি ভ্যারিয়্যান্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এসব হুঁশিয়ার করা সত্ত্বেও ৮ মার্চ স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন ভারত ‘এই প্যানডেমিক প্রায় জয় করে ফেলেছে।’

কেন তিনি এই বাগাড়ম্বর করেছিলেন? একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিনের গড় সংক্রমণ ২০ হাজারের নিচে নেমে আসে যেটি সেপ্টেম্বরে ছিল প্রায় ৯০ হাজার।

প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ঘোষণা দেন করোনা পরাজিত ও সব ধরনের সমাবেশের জন্য সমস্ত জায়গা খুলে দেয়া হয়। সরকারের একদম শীর্ষ মহল থেকে এ ধরনের কথাবার্তা কাজকর্ম দেখে সাধারণ মানুষজনওকরোনার প্রটোকল অগ্রাহ্য করতে শুরু করে।

যদিও মোদি মানুষকে মাস্ক পরতে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে পাঁচটি রাজ্যে গিয়ে বড় বড় নির্বাচনী জনসভা করেন যেখানে সিংহভাগ মানুষের মুখে কোনো মাস্ক ছিল না। ও সব জনসভায় হাজির সরকারের অনেক সিনিয়র মন্ত্রীও মাস্ক পরেননি।

তারপর, অনুমতি দেয়া হলো কুম্ভ মেলায় যেখানে লাখ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হাজির হয়।

‘সরকারের মন্ত্রীরা মুখে যা বলছিলেন তাদের আচরণ ছিল পুরোটা উল্টো, ’ দিল্লিতে বিবিসির সংবাদদাতা বিকাশ পাণ্ডেকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া।

প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ড. শহিদ জামিল বলেন, ‘সরকার দেখতেই পারেনি যে করোনার দ্বিতীয় আরেকটি ঢেউ আসছে। আগেভাগেই তারা বিজয়ের উৎসব শুরু করে দিয়েছিল।’

নগ্ন হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
করোনার এই বিপর্যয় চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে ভারতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা উপেক্ষিত, কতটা নাজুক।

হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসার অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে-এমন করুণ দৃশ্য ভারতের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর বেহাল দশা নগ্ন করে দিয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞের ভাষায়, ভারতের ‘জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো সবসময়ই ভঙ্গুর ছিল। ধনী ও মধ্যবিত্তরা সেটা এখন টের পাচ্ছে।’

ভারতে অবস্থাপন্নরা সবসময় বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেছে কিন্তু দরিদ্র জনগণ সবসময় এমনকি একজন ডাক্তারের দেখা পেতেও চরম ভুগেছে। ভারতে গত ছয় বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হচ্ছে জিডিপির ৩.৬ শতাংশের মত।

ব্রিকস জোটের পাঁচটি দেশের মধ্যে এটি সবচেয়ে কম-ব্রাজিলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যায় সবচেয়ে বেশি ৯.২ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮.১ শতাংশ, রাশিয়ায় ৫.১ শতাংশ এবং চীনে ৫ শতাংশ (২০১৮ সালের হিসাবে)।

সেই তুলনায় উন্নত দেশগুলো তাদের স্বাস্থ্যখাতে অনেক বেশি খরচ করে। যেমন ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে তাদের জিডিপির ১৯.৯ শতাংশ এবং জার্মানি করেছে ১১.২ শতাংশ।

এমনকি শ্রীলংকা বা থাইল্যান্ডের মতো দেশও ভারতের চেয়ে স্বাস্থ্যখাতে বেশি খরচ করে। ভারতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে ১০ জনেরও কম ডাক্তার। কোনো কোনো রাজ্যে এই সংখ্যা পাঁচেরও কম।

ভঙ্গুর প্রস্তুতি
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে গত বছর কয়েকটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা হয়। কিন্তু তারপরও অক্সিজেন হাসপাতাল বেড বা ওষুধের এই সঙ্কট দেখে অনেক বিশেষজ্ঞ বিস্মিত হচ্ছেন।

‘প্রথম দফা সংক্রমণ যখন কমছিল, তখনই দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি ছিল। অক্সিজেন বা রেমডিসিভিরের মতো ওষুধ মজুত করে রাখা জরুরি ছিল। উৎপাদন বাড়ানো দরকার ছিল, ‘বিবিসিকে বলেন, মহারাষ্ট্র রাজ্যের সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মহেশ জাগাডে।

সরকার এখন এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে অক্সিজেন নেয়ার জন্য বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। শিল্পে অক্সিজেনের ব্যবহার বন্ধ করেছে। কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরতে শুরু করার পরই শুধু এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

‘এই পরিকল্পনা-হীনতার যা ফল হয়েছে তা হলো মানুষকে কালোবাজার থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে অক্সিজেন জোগাড় করতে হচ্ছে। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তা রি-ফিল করতে হচ্ছে’ বলেন ড. লাহারিয়া।

সেই সাথে, যাদের পকেটে টাকা আছে তাদেরকে চড়া দামে রেমডিসিভির ও টোসিলিজুমাবের মতো ওষুধ কালোবাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। রেমডিসিভির তৈরি করে এমন একটি ওষুধ কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ওষুধের কোনো চাহিদাই ছিলনা।

‘সরকার কেনার অর্ডার দিলে আমরা ওষুধ তৈরি করে মজুদ করে রাখতাম। তাহলে কোনো সঙ্কট হতো না। এখন আমরা উৎপাদন অনেক বাড়িয়েছি, কিন্তু চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে।’

ব্যতিক্রমী কেরালা
তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার প্রস্তুতি ছিল অনেক ভালো। রাজ্যের কোভিড টাস্ক ফোর্সের সদস্য ড এ ফাতাহউদ্দিন বলেন, তাদের রাজ্যে অক্সিজেন বা ওষুধের কোনো সঙ্ককট নেই কারণ তারা অক্টোবর থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।

জাগাডে বলেন, অন্য রাজ্যগুলোরও কেরালার মতো প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু সাবধান হওয়ার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে করোনা সংক্রমণ এখন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।

‘যে কোনো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আপনাকে বলবেন যে দুর্বল একটি স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে কয়েক মাসের মধ্যে শক্তিশালী করার কোনো উপায় নেই,’ বিবিসিকে বলেন দিল্লিতে একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের মালিক।

‘এখন কোভিডের সাথে যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত বেশি সংখ্যায় মানুষকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা। যাতে হাসপাতালের ওপর চাপ কমে।’

ভারত জুলাইয়ের মধ্যে ৩০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল। কিন্তু ড. লাহারিয়া বলছেন যথেষ্ট ভ্যাকসিন জোগাড়ের পরিকল্পনা সরকারের ছিল না। বরঞ্চ ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই সরকার সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ভ্যাকসিন দেয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

এখন পর্যন্ত ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। ১২ কোটি ৪০ লাখ লোক প্রথম ডোজ পেয়েছেন। ৪৫ বছরের উপরের জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিন দিতে সরকারের হাতে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে। কিন্তু তার জোগাড় অনিশ্চিত।

দুর্ভাগ্য যে ভারতকে বিশ্বের ওষুধ প্রস্তুতকারি হিসাবে দেখা হলেও তারাই এখন ওষুধ ও ভ্যাকসিনের সঙ্কটে ভুগছেন।

ড. লাহারিয়া বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে তাদেরকে বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হবে কারণ ‘এটিই বিশ্বের শেষ প্যানডেমিক নয়।’ ভবিষ্যতে আরেকটি প্যানডেমিক দ্রুত আসবে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা


আরো সংবাদ



premium cement
তৃণমূল সংগঠনের মজবুতির জন্য কাজ করতে হবে : মাওলানা আব্দুল হালিম ‘দেশ ও জাতি দুঃসময় পার করছে’ ওসমানীনগরে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২ সহ-অধিনায়ক হতে পারেন রিজওয়ান মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু

সকল