২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তরুণদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ

- ছবি - সংগৃহীত

মিয়ানমারে সামরিক শাসন অবসানের দাবিতে গণ-বিক্ষোভ চলছে এবং কমপক্ষে ৫৫ জন বিক্ষোভকারী মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ। ইয়াঙ্গুন শহরে হচ্ছে মূল বিক্ষোভ। সেখান থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে -

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। দেশটির মানুষ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, রাতভর সেনা অভিযান, অবৈধভাবে গ্রেফতার, বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় ধাওয়া ও মারধর করা, ফাঁকা গুলি ছোঁড়া বা দূর থেকে মাথা বা বুক লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।

এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।

একজন কমবয়েসী তরুণী মাথায় গুলি লেগে মারা যান। তার পরনে টি শার্টে লেখা ছিল ‘এভ্রিথিং উইল বি ওকে’ অর্থাৎ সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

যদি আপনি ইদানীং দিনের বেলা ইয়াঙ্গনের আশেপাশে থাকেন, তবে আপনার প্রথম যে বিষয়টি নজরে
আসবে তা হলো তীব্র গন্ধযুক্ত কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া।

সেখানকার ছোট ছোট শিশুদের পর্যন্ত নিজ বাড়ির ভেতরে কাঁদানে গ্যাসের স্বাদ নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে মায়েদের অভিশাপ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

তাজা বুলেট, রাবার বুলেট, স্টান গ্রেনেড, জল কামান, কাঁদানে গ্যাস। যেটার নামই আপনি বলুন, মিয়ানমার এক মাসেরও কম সময়ে এর সবকটির দেখা পেয়েছে।

এরপরও প্রতিদিন নতুন করে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ।

সামরিক জান্তার নৃশংসতায় বিক্ষোভকারীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠলেও - এখন পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগ বিক্ষোভই ছিল শান্তিপূর্ণ।

সৃজনশীল উপায়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ :

ছাত্র, বৌদ্ধ ভিক্ষু, নারী, চাকুরীজীবী এমনকি কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

এ নাগরিক আন্দোলনে অংশ নেয়া কয়েকজন পুলিশ প্রকাশ্যে বলেছেন, তারা আর সামরিক শাসকদের হয়ে কাজ করবেন না। তারা জনগণের সেবা করবেন।

এখন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা বেশ সংগঠিত এবং সংকল্পবদ্ধ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনি বিভিন্ন আঙ্গিকে মানুষকে প্রতিবাদ করতে দেখবেন।

কেউ কেউ হয়তো শুধু তালি বাজিয়ে গান গাইছেন - কেউবা বহুতল ভবনগুলোর সামনে দিয়ে সারং পরে
ঘোরাফেরা করছেন। সারং হল মিয়ানমারের প্রচলিত পোশাক যাকে বার্মিজ ভাষায় 'থামি' বলা হয়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এগুলো ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়।

কিন্তু, সারং কেন? মিয়ানমারের মানুষ বিশ্বাস করে যে সৈন্যরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং তারা সারং ভয় পায়, সেনারা মনে করে এটি তাদের শক্তি এবং আধ্যাত্মিক বলকে দুর্বল করে দিতে পারে।

প্রধান সড়কগুলোয় মিছিল-সমাবেশ করার কারণে সামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদেরছত্রভঙ্গ করে দেয়।

এরপর থেকে বিক্ষোভকারীরা তাদের আশেপাশের এলাকায় নিজস্ব জায়গা তৈরি করে বিক্ষোভ শুরু করেছে।

শহরের প্রায় সর্বত্রই বালির ব্যাগ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট দুর্গ, পানিভর্তি ডাস্টবিন বা অস্থায়ী ব্যারিকেড দেখা যায়।

আশেপাশের লোকেরা একে অপরের প্রতি সমর্থন দিয়ে চলেছেন।

অনেককে বিনামূল্যে খাবার বা প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্রপাতি বিতরণ করতে দেখা গেছে।

সবার চাওয়া একটাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সামরিক একনায়কতন্ত্রকে উৎখাত করা।

একই সাথে, তারা একে অপরকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সেইসাথে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ারপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে।

যারা বাড়িতে থাকেন, তারা রাতের বেলা থালাবাসন বাজিয়ে প্রতিবাদ করছেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেশটির মানুষবিশ্বাস করে এভাবে মন্দকে এড়ানো যায়।

সামরিক বাহিনীর সহিংস অবস্থানের মুখেও সাধারণ মানুষ তাদের আন্দোলনের চেতনা জিইয়ে রাখতে রাতের বেলা তাদের বারান্দা থেকে কিংবা বসার ঘর থেকে গণতন্ত্রপন্থী স্লোগান দিচ্ছেন। আবার অনেক জায়গায় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নানা গানের সুর ভেসে আসে।

এর আগে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এ গানগুলো লেখা হয়েছিল।

যেমন: ‘কাবার মা কেয়ায় বু’ যার অর্থ ‘শেষ অবধি আমরা ভুলব না’ কিংবা ‘থোয়ে থিসার’ যার মানে রক্ত শপথ।

আবার আন্দোলনকে ঘিরে তরুণ প্রজন্ম নতুন করে গান রচনা করেছেন। এরমধ্যে একটি হল ‘রিজেক্ট দ্য ক্যু’ বা অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করো।

ওই গানটির একটি লাইনে শপথ করা হয় যে : ‘আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো।’

রাস্তায় বের হওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তাই কিছু মানুষের জন্য ক্ষোভ বা দুঃখ প্রকাশের একমাত্র জায়গা হয়ে উঠেছে তাদের নিজ বাড়ি।

বিক্ষোভে নিহতদের স্মরণে কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছেন। নিহতদের তারা ‘ফলেন হিরোস’ বলে সম্বোধন করছেন।

স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে হবে :

সন্ধ্যার শেষ দিকে, আপনি হয়তো রাস্তায় দেখতে পাবেন যে তরুণদের কয়েকটি দল তিন-আঙুলের বিপ্লবী স্যালুট দিচ্ছে। এটা দেশটির সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

তরুণরা বেশ বুদ্ধি করে রাস্তায় স্লোগান লিখছেন যা আজকাল কেবল ইয়াঙ্গনে নয়, বরং সারা দেশের বড় বড় শহরগুলোয় দেখা যাচ্ছে।

‘সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করুন’ বা ‘আমরা গণতন্ত্র চাই’ এ ধরণের লেখাগুলো তারা মুছে ফেলতে প্রশাসনের অনুগত পুলিশ বাহিনীকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

পরের দিন, অন্য কোনো রাস্তায় একই কথা লিখছেন এ তরুণরা।

একইসাথে, সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর বর্বর আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের থেকে আরো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দাবি করেছেন।

তারা এখন আগের চাইতেও হতাশ হয়ে পড়েছেন কারণ জাতিসংঘ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক সংস্থা
আসিয়ান এ সামরিক সরকারের বর্বর আচরণ আটকাতে পারেনি।

এ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন ঘোষণা, বিবৃতি কিংবা নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলোয়, অনেকগুলো প্ল্যাকার্ডে একটি কথা লেখা আছে : ‘জাতিসঙ্ঘের পদক্ষেপ নিতে আর কয়টি লাশ প্রয়োজন?’

তবে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের উপর বিশেষ করে চলমান অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাজপথের বিক্ষোভ এবং নাগরিক আন্দোলনের উপর নির্ভর করছে।

একদিন, একজন বিক্ষোভকারীর সাথে আমার কথা হয়। বিক্ষোভ চলাকালীন নিয়মিত গ্যাস মাস্ক ব্যবহারের কারণে তার মুখে গভীর দাগ পড়ে গিয়েছে দেখেছি।

তিনি তার চোখের গগলস সরিয়ে আমাকে বলেন, ‘আমাদের যুগেই সামরিক একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটাতে হবে।’

তিনি তার হেলমেটে তার রক্তের গ্রুপ এবং তার আত্মীয়র একটি যোগাযোগ নম্বর লিখে রেখেছিলেন।

জেনারেশন জেড, যারা এ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে, তারা সামরিক শাসনের এ তিক্ত
অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে।

সহিংসতা ও হামলার এ দুঃস্বপ্ন হয়তো এত সহজে যাবে না, কারণ মিয়ানমার কখনই তার সামরিক জান্তার প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।

তারপরও, তরুণ প্রজন্ম এ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ়তা ও সংকল্প দেখিয়ে যাচ্ছে।

আরেকজন তরুণ প্রতিবাদীর কণ্ঠে ওই একই শব্দগুলো উচ্চারিত হল, ‘আমাদের যুগেই সামরিক একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটাকে হবে।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement