২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমেরিকায় অভিবাসন আইন ও মানুষের ভোগান্তি

কয়েক দশক ধরে সীমান্তে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন সীমান্তে এধরনের মানুষের স্রোত তারা কখনও দেখেননি। - ছবি : বিবিসি

ট্রাম্প শাসনামলের বিতর্কিত অভিবাসন আইন ‘টাইটেল ফর্টি টুর' মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ ১১ মে। তিন বছরের বেশি চালু থাকার পর মার্কিন অভিবাসন নীতিতে নাটকীয় একটি বদল ঘটতে চলেছে এ আইনের মেয়াদ শেষ হবার মধ্যে দিয়ে।

বহুল সমালোচিত এ আইন উঠে যাবার মুহূর্তে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসীদের ঢল নামবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সীমান্তে কর্মকর্তারা বলছেন তাদের ধারণা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইন বদলানোর পর প্রতিদিন ১০ হাজার করে অভিবাসীর ঢল নামবে সীমান্তে।

আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে কড়া রোদের মধ্যে শুকনো বালুর বিরান ভূমিতে এখনই শত শত মানুষ শুধু এই আইন উঠে যাবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।

মঙ্গলবারই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্বীকার করেছেন, ‘কিছু সময়ের জন্য সেখানে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।’ কারণ মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় ঢোকার জন্য বহু মানুষের অপেক্ষা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

অভিবাসন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে চালু হওয়া এ আইনের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং কিছু কিছু ডেমোক্র্যাট সদস্য বলেছেন এ নীতির কারণে বহু আশ্রয়প্রার্থী আমেরিকায় ঢুকতে পারছেন না।

অন্যদিকে, রিপাবলিকানরা এখনো যুক্তি দেখাচ্ছেন বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হওয়া রুখতে এ আইনের প্রয়োগ এখনো বলবৎ রাখা উচিত। সীমান্তে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য তারা দুষছেন খোদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে।

ফলে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে অভিবাসন ইস্যুতে এ আইন ক্রমশই তীব্র একটা বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠছে।

ভাগ্য ফেরাতে সীমান্তে মানুষের ঢল
ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত ও ভীত শত শত মানুষ এ মুহূর্তে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে দু‘দেশের মাঝখানে বিশালাকৃতি ইস্পাতের সীমান্ত বেড়ার পাশে জানাচ্ছেন মেক্সিকোর সিউদাদ হুয়ারেজ থেকে বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা সারা স্মিথ।

যে দেশে পৌঁছানোর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে এসেছেন, সেই দেশ তারা দেখতে পাচ্ছেন বেড়ার ফাঁক দিয়ে। কিন্তু এদের কেউই জানেন না তাদের শেষ অবধি ওই বেড়া পার হতে দেয়া হবে কিনা।

রোজারিও মেডিনা সারা স্মিথকে জানালেন আবর্জনার স্তুপ ঘেঁটে তিনি তার নাতিনাতনিদের জন্য খাবার জোগাড় করছেন। শিশুদের বোতলে খাওয়ানোর পানি আনছেন দূষিত রিও গ্র্যান্ডে নদী থেকে।

গত আট দিন ধরে সীমান্তে বসে আছেন তিনি। তাদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার চোখ উপছে পানি গড়িয়ে পড়ল। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে বাচ্চাদের ঠোঁটে ফোস্কা পড়ে গেছে।

প্রথমে পায়ে হেঁটে দুর্গন্ধময় নদী পার হয়ে, তারপর ধুলাবালির মধ্যে ধারালো ছুরির ফলা বসানো তারের বেড়ার ছোট্ট এক ফাঁক গলে অন্য পাশে পৌঁছে মিজ স্মিথ শোনেন এসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের যাত্রাপথের ভয়াবহ কাহিনি।

মিলেক্সি গোমেজ তাকে জানান তিনি এসেছেন ভেনেজুয়েলা থেকে। গহীন ও অজানা অরণ্যের মধ্যে দিয়ে চার সন্তানকে নিয়ে পায়ে হেঁটে পথ পাড়ি দিয়েছেন। তাদের কোলে নিয়ে পার হয়েছেন খাড়া পাহাড়, ট্রেনের টিকিট কেনার সামর্থ্য না থাকায় তাদের নিয়ে লাফ দিয়ে চড়েছেন ট্রেনের ছাদে। এখন ধুলাকাদার মধ্যে ঘুমাচ্ছেন তারা সবাই। তার দু‘যমজ ছেলের সর্দিজ্বর ব্রঙ্কাইটিসে রূপ নিতে পারে বলে তার আশঙ্কা।

তিনি বলেন,‘আমরা মারাত্মক কষ্টের মধ্যে কাটাচ্ছি।’ ‘রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ঘুমাতে পারি না, খাবার পয়সা নেই, ধোয়ামোছার কোনো ব্যবস্থা নেই। বারবার ঈশ্বরকে ডাকছি, বাচ্চাদের এখানে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখব!’

ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তির বেড়াজাল
বিবিসি সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, সীমান্তের এ দৃশ্য খুবই বিরল। আমেরিকায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের সাধারণত রাখা হয় হুয়ারেজ শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকদিনে সীমান্তে যে পরিমাণ মানুষ জড়ো হয়েছেন তা ব্যাপক। এ ঢল সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।

এত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া অসম্ভব বলে তারা বলছেন। কয়েক দশক ধরে সীমান্তে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এ ধরনের দৃশ্য তারা কখনো দেখেননি।

সেখানে জড়ো হওয়া অধিকাংশ মানুষ বলেছেন এ সপ্তাহে আমেরিকায় ঢোকার আইন বদলাচ্ছে এমনটা তারা শুনেছেন। কিন্তু অভিবাসীদের জন্য এ পরিবর্তনের অর্থ কী তা নিয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে ভুয়া খবর এবং তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।

অনেকেরই ধারণা কোভিডের সময় চালু হওয়া ‘টাইটেল ফর্টি টু’ যার আওতায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের সহজেই তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ ছিল। তা উঠে গেলেই আমেরিকায় ঢোকার পথ সহজ হবে।

আর ওই কারণেই দলে দলে এত মানুষ সীমান্তে এসে ভিড় জমিয়েছেন।

অনেকে আবার শুনেছেন আমেরিকায় ঢুকতে হলে ১১ মে মধ্যরাতের আগে সীমান্তে পৌঁছাতে হবে। যেমনটা শুনেছেন মিলেক্সি। ১১ মে মাঝরাতের আগে সীমান্তে লাইন দিতে না পারলে আমেরিকায় ঢোকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। তিনি বলেছেন বিবিসিকে।

তাই উদ্বেগে, আশঙ্কায় সীমান্তে বাচ্চাদের নিয়ে কঠিন সময় পার করছেন তিনি এবং তার মত শত শত অভিবাসন প্রত্যাশী।

টাইটেল ফর্টি টু কী এবং কেন তা উঠে যাচ্ছে?
টাইটেল ফর্টি টু প্রথম চালু হয় ১৯৪৪ সালে তখন এ আইনের নাম ছিল জন স্বাস্থ্য আইন। রোগব্যাধির বিস্তার রোধ করতে আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে এ আইন ব্যবহারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।

আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে এ আইনের প্রয়োগ নতুন করে আবার সামনে আসে ২০২০ সালের মার্চ মাসে। সীমান্ত দিয়ে কোভিডের বিস্তার ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসন এ আইনের প্রয়োগ অনুমোদন করে।

মেক্সিকো থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় ঢুকতে চাওয়া মানুষ, এমনকী মানবিক কারণে যারা আমেরিকায় আশ্রয়প্রার্থী তাদেরও প্যানডেমিকের যুক্তি দেখিয়ে এই আইনের বলে মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাদের সোজা মেক্সিকোয় ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

এরপর ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তার প্রশাসন জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলার যুক্তি দিয়ে এ নীতি বজায় রাখেন আরো এক বছরের ওপর।

আমেরিকার শুল্ক ও সীমান্ত সুরক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থ বছরে টাইটেল ফর্টি টু নীতিমালা ব্যবহার করে ২০ লাখের ওপর মানুষকে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

আমেরিকার স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারক সংস্থা ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ২০২২ এর এপ্রিল মাসে যুক্তি দেয়, জন স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেহেতু কমে গেছে তাই এ নীতি এখন তুলে নেয়া যাবে।

তবে রিপাবলিকান পার্টি নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যগুলো এ আইনবিধি চালু রাখার পক্ষে আইনি চ্যালেঞ্জ জানানোর কারণে টাইটেল ফর্টি টু-র তুলে নেবার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটে।

এখন কেন্দ্রীয়ভাবে ১১ মে তারিখ থেকে কোভিড সংক্রান্ত সব পদক্ষেপের যেহেতু অবসান হচ্ছে, তাই কর্মকর্তারা জানান এরই সাথে সঙ্গতি রেখে টাইটেল ফর্টি টু-ও তুলে নেয়া হবে।

টাইটেল ফর্টি টু তুলে নেয়ার অর্থ কী?
প্রথমত আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত পার হবার জন্য সেখানে যে অপ্রত্যাশিত সংখ্যায় মানুষের ঢল নামবে তার মধ্যে থেকে কারা আইনত অভিবাসনের জন্য আবেদনের যোগ্য সেটা হয়ে দাঁড়াবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন তাদের ধারণা সীমান্তে প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী ভিড় জমাবেন।

টাইটেল ফর্টি টুর অধীনে বহু অভিবাসীকে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করার অনুমতিই দেয়া হয়নি। কিন্তু এ ধারা উঠে যাবার পর আমেরিকার পুরনো অভিবাসন নীতি অনুযায়ী আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন যাচাই বাছাই করে দেখা হবে এবং তাদের ফেরত পাঠানো যাবে একমাত্র যদি প্রমাণিত হয় তারা আবেদনের যোগ্য নন।

আমেরিকা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নতুন যেসব পদক্ষেপ চালু করেছে তাতে আশ্রয়প্রার্থীদের ‘দ্রুত’ সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের আবেদন যাচাইবাছাই করার কথা বলা হয়েছে এবং তারা যোগ্য বিবেচিত না হলে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর নীতি চালু করা হয়েছে।

বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে কেউ ধরা পড়লে অন্তত ৫ বছর তার আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করা হবে। এবং সে ‘আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে অযোগ্য বিবেচিত’ হবে।

অবৈধ পথে সীমান্ত পার হতে অভিবাসীদের নিরুৎসাহিত করতে বাইডেন প্রশাসন বৈধ অভিবাসনের বেশ কিছু পথ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।

দোসরা মে ঘোষণা করা এক চুক্তির অংশ হিসেবে মেক্সিকো কিউবা, হাইতি, নিকারাগুয়া আর ভেনেজুয়েলা থেকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার অভিবাসী গ্রহণ অব্যাহত রাখতে রাজি হয়েছে। এ চারটি দেশ থেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত পার হবার বেশি ঘটনা ঘটে।

আমেরিকা এ চুক্তিতে হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা আর এল সালভাডোর থেকে মোট ১ লাখ অভিবাসী নিতে সম্মত হয়েছে। এসব দেশের মানুষের অনেকের আত্মীয়স্বজন থাকেন আমেরিকায়।

অভিবাসীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করতে যেসব অপরাধী চক্র বা দালালরা কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে আমেরিকা। ভুয়া ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর বন্ধেও তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানিয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement