২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের ৭ কারণ

প্রেসিডেন্ট নিক্সন মনে করতেন, সৈন্য প্রত্যাহার হলেই দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের পতন ঘটবে - ছবি : বিবিসি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের অবিসংবাদিত প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং দেশটি বিশ্বাস করতো যে তার সামরিক বাহিনীও একইভাবে সর্বশক্তিমান। তবুও মাত্র আট বছর ধরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিপুল অর্থ ও জনবল ক্ষয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামের বাহিনী এবং তাদের গেরিলা মিত্র ভিয়েত কংয়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল।

ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্যদের চূড়ান্ত প্রত্যাহারের ৫০তম বার্ষিকীতে (২৯ মার্চ, ১৯৭৩) বিবিসি দু’জন বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদের কাছে জানতে চেয়েছিল ঠিক কী কারণে আমেরিকা ওই সংঘাতে হেরে গিয়েছিল। শীতল যুদ্ধ তখন তুঙে। কমিউনিস্ট এবং পুঁজিবাদী বিশ্বশক্তি তখন একে অপরের মুখোমুখি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ফ্রান্স ইন্দোচীনে তার উপনিবেশ ধরে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। এক শান্তি সম্মেলনে এখনকার ভিয়েতনামকে তারা ভাগ করে কমিউনিস্ট উত্তর অংশ এবং দক্ষিণে মার্কিন-সমর্থিত রাষ্ট্র তৈরি করেছিল।

কিন্তু ফরাসিদের পরাজয় সে দেশে সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারেনি। তাদের ভয় ছিল যে ভিয়েতনাম যদি সম্পূর্ণভাবে কমিউনিস্ট হয়ে যায় তাহলে আশপাশের দেশগুলোতেও কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়বে। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রকে ওই সংঘাতে জড়িয়ে ফেলেছিল, যে লড়াই এক দশক ধরে চলেছিল এবং লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

তাহলে বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সামরিক শক্তি কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের বিদ্রোহীদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হলো? এনিয়ে সাধারণভাবে যেসব ব্যাখ্যা রয়েছে সে সম্পর্কে বলছেন দু’জন বিশেষজ্ঞ।

যুদ্ধের দায়িত্ব ছিল বিশাল
বিশ্বের অন্য প্রান্তে গিয়ে যুদ্ধ চালানো ছিল বিশাল এক দায়িত্ব। যুদ্ধ যখন তুঙে সে সময় ভিয়েতনামে মোতায়েন মার্কিন সৈন্যসংখ্যা ছিল পাঁচ লখেরো অধিক।

এই যুদ্ধে অর্থ ব্যয়ের কথা শুনলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ২০০৮ সালে মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে যুদ্ধের মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল আটষট্টি হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার (আজকের মূল্যে পঁচানব্বই হাজার কোটি ডলারেরও বেশি)।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা এর চার গুণেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে। কোরিয়াতেও তারা একটি দূরপাল্লার যুদ্ধ চালিয়েছে। তাই ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে মার্কিন নেতাদের মনে আত্মবিশ্বাসের কোনো ঘাটতি ছিল না।

ব্রিটেনের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির ওপর একজন বিশেষজ্ঞ ড. লুক মিডাপ বলছেন, যুদ্ধের গোড়ার দিকে সাধারণভাবে ব্যাপক আশাবাদ ছিল।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধে এটি সত্যিই একটি অদ্ভুত ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো সমস্যা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিল, মার্কিন বাহিনী ওই পরিবেশে গিয়ে কাজ করতে পারবে কিনা। তা নিয়েও অনেক সংশয় ছিল। কিন্তু তবু ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন সরকার নিশ্চিত ছিল যে ওই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হবে।’

কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরে, বিশেষভাবে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে কমিউনিস্ট টেট আক্রমণের পর। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের অর্থ জোগানোর প্রশ্নে মার্কিন কংগ্রেসের সমর্থনের অভাব ঘটতে শুরু করলে ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

তবে মার্কিন সেনাবাহিনীর আদৌ ভিয়েতনামে ঢোকা উচিত ছিল কিনা, তা নিয়েই ড. মিডাপ প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বিতীয় একজন বিশেষজ্ঞ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক টুং ভুও তার সাথে একমত।

এ ধরনের লড়াইয়ের জন্য মার্কিন বাহিনী ছিল অনুপযুক্ত
হলিউডের ছায়াছবিতে প্রায়ই দেখা যায়, অল্পবয়সী মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনামের জঙ্গলের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে ভিয়েত কং বিদ্রোহীরা গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে অবলীলায় চলাফেরা করছে এবং চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে।

মিডাপ বলেছেন, ‘মার্কিন বাহিনীকে যে ধরনের পরিবেশের মধ্যে গিয়ে লড়াই চালাতে বলা হয়েছে, সে ধরনের পরিবেশে কাজ করা কোনো বড় আকারের সামরিক বাহিনীর জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। ওইসব অঞ্চলে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে গহীন অরণ্য। কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যে কোনটির টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি সেই গল্প হয়তো কিছুটা অতিরঞ্জিত-ভাবেই ছড়ানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় এমন গালগল্প তৈরি হয়েছিল যে মার্কিন সেনাবাহিনী পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। উত্তর ভিয়েতনামিজ কিংবা ভিয়েত কং গেরিলারা ছিল এতে অনেক বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু একথা সত্যি না। ওই বিপদসঙ্কুল পরিবেশে টিকে থাকা এবং টিকে থেকে লড়াই চালানোর জন্য উত্তর ভিয়েতনামিজ সেনাবাহিনী এবং ভিয়েত কং গেরিলাদেরও প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছিল।’

মিডাপের মতে, আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার এই যে লড়াই কখন হবে এবং কোথায় হবে সেটা ঠিক করত বিদ্রোহীরা। হামলা চালানোর পর তারা লাওস এবং ক্যাম্বোডিয়ার সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেত। তাদের অনুসরণ করে ওই দু’টি দেশে ঢুকে পড়া মার্কিন বাহিনীর জন্য ছিল নিষিদ্ধ।

অধ্যাপক ভু-এর মতে, শুধু ভিয়েত কং গেরিলাদের বিরুদ্ধে মনোযোগ মার্কিন বাহিনীকে পরাজয়ের পথে ধাবিত করেছিল।

তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিদ্রোহীরা নিজেরা কখনই সায়গন দখল করতে পারতো না।’ এটা ছিল কৌশলগতভাবে ভুল পদক্ষেপ। এর ফলে উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল এবং এই অনুপ্রবেশকারী বাহিনীর হাতেই শেষপর্যন্ত যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটে দেশের মধ্যেই
ইউএস ন্যাশনাল আর্কাইভস-এর হিসেব অনুযায়ী, ১৯৬৮ সাল নাগাদ ৯৩ ভাগ মার্কিন বাসাবড়িতে অন্তত একটি করে টিভি সেট ছিল এবং সেই টিভিতে প্রতিদিন তারা যে ভিডিও ফুটেজ দেখতেন তাতে আগের যুদ্ধগুলির তুলনায় ছিল কম সেন্সর এবং সেগুলো দেখানো হতো তাৎক্ষণিকভাবে।

এ কারণেই টেট আক্রমণের সময় সায়গনে মার্কিন দূতাবাসের চারপাশে লড়াইয়ের দৃশ্যগুলো ছিল এতটা শক্তিশালী। দর্শকরা প্রায় সাথে সাথে দেখতে পেতেন ভিয়েত কং গেরিলারা কীভাবে দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের কেন্দ্রস্থলে এবং মার্কিন টিভি দর্শকদের বৈঠকখানার একেবারে ভেতরে এই যুদ্ধটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৬৮ সালের পর থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের নিউজ কভারেজ ছিল নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, পঙ্গু ও নির্যাতনের ছবিকে ঘিরে। টিভি এবং সংবাদপত্রে এসব খবর তুলে ধরা হচ্ছিল। এতে অনেক আমেরিকান ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের মনোভাব যুদ্ধবিরোধী হয়ে পড়েছিল।

সারা দেশ জুড়ে বিশাল বিশাল সব প্রতিবাদ বিক্ষোভ গজিয়ে উঠছিল।

১৯৭০-এর ৪ মে এরকমই একটি বিক্ষোভে ওহাইওর কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ন্যাশনাল গার্ডস বাহিনী চারজন শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ‘দ্য কেন্ট স্টেট ম্যাসাকার’ আরো বেশি লোককে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল।

ড্রাফট নামে পরিচিত একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় নিয়োগ ব্যবস্থা, যেখানে যুবকদের জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হতো। সেটাও জনসাধারণের মনোবলের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছিল। অন্যদিকে ছিল খবরের ছবি যেখানে দেখানো হচ্ছিল কফিনে ভরে মার্কিন সৈন্যদের লাশ দেশে ফেরত আনা হচ্ছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ৫৮ হাজার মার্কিন সৈন্য হয় নিহত, নয়তো নিখোঁজ হয়েছিল।

প্রফেসর ভু-এর মতে, উত্তর ভিয়েতনামের জন্য এটি বড় রকমের একটি সুবিধা ছিল। যদিও তাদেরো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রের মিডিয়ার ওপর তাদের ছিল নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ এবং তথ্য প্রবাহের ওপর ছিল একচেটিয়া অধিকার।

তিনি বলেন, ‘কমিউনিস্টরা যেভাবে পেরেছিল, সেভাবে জনমত গঠনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের সামর্থ্য কিংবা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না।’

তিনি আরো বলেন,‘(উত্তর ভিয়েতনামের) হাতে ছিল ব্যাপক প্রচার ব্যবস্থা। তারা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল এবং যেকোনো ভিন্নমতকে দমন করেছিল। যারাই যুদ্ধের ব্যাপারে সরকারের সাথে দ্বিমত পোষণ করত তাদের সরাসরি কারাগারে পাঠানো হতো।’

দক্ষিণ ভিয়েতনামের হৃদয় জয়ের লড়াইয়েও হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র
ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল এটি একটি ব্যতিক্রমী নৃশংস সংঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। নাপাম বোমা (এটি একটি পেট্রোকেমিক্যাল দাহ্য পদার্থ যা দুই হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় জ্বলে ওঠে এবং যা কিছু স্পর্শ করে তাকেই আঁকড়ে ধরে থাকে) এবং এজেন্ট অরেঞ্জ (এটি ভিন্ন একটি রাসায়নিক যা অরণ্যে গাছের আচ্ছাদন ধ্বংস করে। এর ফলে ফসল ধ্বংস হয়।) এই দু’টি অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমেরিকার ব্যাপারে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ মিশনগুলোতে অগণিত নিরপরাধ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাগুলোর একটি ঘটে ১৯৬৮ সালে। মাই লাই গণহত্যায় মার্কিন সৈন্যরা কয়েকশ’ ভিয়েতনামিজ নাগরিককে হত্যা করে।

বেসামরিক মানুষের মৃত্যুতে যুদ্ধের প্রতি স্থানীয় জনগণের সমর্থন কমে যায়। এরা হয়তো ভিয়েত কং-কেও সমর্থন করতে চায়নি।

ড. মিডাপ বলেন, ‘এটা এমন নয় যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খাঁটি কমিউনিস্ট ছিলেন। বেশিরভাগ মানুষ কেবল বেঁচে থাকতে চাইছিলেন এবং যে কোনো উপায়ে এই যুদ্ধ থেকে পালাতে চাইছিলেন।’

অধ্যাপক ভু-ও এ বিষয়ে একমত যে মানুষের হৃদয় জয় করার সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা সফল হয়নি।

তিনি বলেন,‘একটি বিদেশি সেনাবাহিনীর জন্য জনগণকে খুশি রাখা সবসময়ই কঠিন। এরা যে (স্থানীয় জনগণের মধ্যে) বিশেষ জনপ্রিয় হবে না, এটা আপনি ধরেই নিতে পারেন।’

কমিউনিস্টদের মনোবল ছিল জোরালো
ড. মিডাপ বিশ্বাস করেন, সাধারণভাবে যারা কমিউনিস্টদের পক্ষ হয়ে লড়াই করার পথ বেছে নিয়েছিলেন তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য যাদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল, তাদের চেয়ে ছিলেন অনেক বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ।

তিনি জানান, ‘যুদ্ধ চলার সময় বিপুলসংখ্যক কমিউনিস্ট বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু গবেষণা চালানো হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‍্যান্ড কর্পোরেশন বন্দিদের অনুপ্রেরণা ও মনোবলের ওপর এই গবেষণাগুলি চালিয়েছিল। এরা জানতে চেয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামিজ এবং ভিয়েত কংরা কেন এই যুদ্ধ করছিল। প্রতিষ্ঠান দু’টি সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বন্দিদের অনুপ্রেরণা এসেছিল দেশপ্রেম থেকে। অর্থাৎ, তারা দেশকে একত্রিত করে একটি একক সরকার গঠন করতে চাইছিল।’

বিপুল সংখ্যক গেরিলার হতাহতের পরেও কমিউনিস্ট শক্তিগুলির যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল সেটা সম্ভবত তাদের মনোবলের প্রমাণ। অন্যদিকে, মার্কিন নেতৃত্ব আচ্ছন্ন ছিল শত্রুপক্ষের নিহত সৈন্যদের দেহ গণনা নিয়ে। তারা মনে করেছিলেন, যে হারে শত্রু যোগ দিচ্ছে তার চেয়েও দ্রুত হারে শত্রুকে হত্যা করতে পারলে কমিউনিস্টরা লড়াই চালানোর ইচ্ছা হারিয়ে ফেলবে।

যুদ্ধের সময় প্রায় ১১ লাখ উত্তর ভিয়েতনামিজ এবং ভিয়েত কং যোদ্ধা নিহত হয়। কিন্তু তারপরো তবুও কমিউনিস্টরা যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সৈন্য সংখ্যা জুগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

অধ্যাপক ভু অবশ্য ঠিক নিশ্চিত নন যে উত্তর ভিয়েতনামের মনোবল সবল ছিল। তবে তিনি স্বীকার করেন যে উত্তরের সৈন্যদের যেভাবে মগজ ধোলাই করা হয়েছিল তার মধ্যে দিয়ে একেক জন সৈন্য একেকটি অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘তারা মানুষকে তাদের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রচার এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা মানুষকে বুলেটে পরিণত করতে সফল হয়েছিল।’

দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার ছিল অজনপ্রিয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত
ড. মিডাপ বলছেন, ‘যে সমস্যার মুখোমুখি দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার হয়েছিল, তা ছিল তার বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব এবং প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে ওই সরকারের সম্পর্ক। উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যে বিভাজন সেটা সবসময় ছিল কৃত্রিম, স্নায়ুযুদ্ধের ফলে এটি তৈরি হয়েছিল। ভিয়েতনামকে দু’টি দেশে বিভক্ত করার কোনো সাংস্কৃতিক, জাতিগত বা ভাষাগত কারণ ছিল না।’

তিনি মনে করেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামে সংখ্যালঘু ক্যাথলিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

যদিও এই গোষ্ঠীটি সেই সময়ের জনসংখ্যার সম্ভবত মাত্র ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ ছিল (ভিয়েতনামে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ), অনেক ক্যাথলিক নিপীড়নের ভয়ে উত্তর ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যাকে ড. মিডাপ বর্ণনা করছেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজনীতিতে ‘একটি ক্রিটিকাল মাস’ বলে।

দক্ষিণ ভিয়েতনামের এসব ক্যাথলিক রাজনীতিবিদ যেমন, প্রথম রাষ্ট্রপতি এনগো ডিন ডিয়েম, যুক্তরাষ্ট্রে এদের ক্ষমতাধর ক্যাথলিক বন্ধু ছিলেন, যেমন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি।

ড. মিডাপ বলেন, ‘বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রকে অজনপ্রিয় করে তুলেছিল’ ক্যাথলিক ধর্মীয় সংখ্যালঘুর এই আধিপত্য।

তিনি মনে করেন, এটি একটি বৈধতার সঙ্কট তৈরি করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মনে করছিল, তাদের সরকারকে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। সরকারটি ছিল ফরাসি ঔপনিবেশিকতার ফসল। কারণ, অনেক ক্যাথলিক ফরাসিদের পক্ষ হয়ে লড়াই করেছিল।

ড. মিডাপ,‘ভিয়েতনামের মাটিতে পাঁচ লাখ আমেরিকান সৈন্যের উপস্থিতি সেই সত্যটিকে তুলে ধরেছিল যে এই সরকার সব দিক থেকে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। দক্ষিণ ভিয়েতনাম কখনই এমন কোনো রাজনৈতিক মন্ত্র তৈরি করতে পারেনি যা দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে বোঝানো যেত যে ওই লড়াইটি ছিল এক বাঁচা-মরার লড়াই।’

তিনি বলছেন, ‘এর ফলেই প্রশ্ন উঠেছে যে দুর্নীতিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটি রাষ্ট্রকে ঠেকা দেয়ার জন্য সেখানে মার্কিন সৈন্য পাঠানো আদৌ দরকার ছিল কিনা। সূচনা থেকে তার ধ্বংস পর্যন্ত (ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র) ছিল একটি অবিশ্বাস্যভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত এক দেশ। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিশাল মার্কিন অর্থ সাহায্য দেশটির দুর্নীতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। সর্বব্যাপী দুর্নীতি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল।

তিনি আরো বলেন,‘সে সময় ঘুষ না দিয়ে কেউ বেসামরিক কিংবা সামরিক কোনো পদ অধিকার করতে পারতেন না। সশস্ত্র বাহিনীর ওপর এটা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এর অর্থ হলো যে যুক্তরাষ্ট্র কখনই একটি নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ এক দক্ষিণ ভিয়েতনামিজ সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি। সুতরাং এটা অনিবার্য ছিল এবং প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সেটা স্বীকারও করেছিলেন যে ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে মার্কিন সৈন্যরা যখন দেশে ফিরে যাবে, তখন প্রায় সাথে সাথেই দক্ষিণ ভিয়েতনাম রাষ্ট্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে।’

কিছু সীমাবদ্ধতা, যা উত্তর ভিয়েতনামের ছিল না
তবে অধ্যাপক ভু একমত নন যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য পরাজয় অনিবার্য ছিল। তিনি মনে করেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তী গবেষণাগুলিতে সাধারণত অজুহাত খোঁজার চেষ্টা চলেছে। তারা চায়, এই পরাজয়ের জন্য কাউকে দায়ী করা হোক, এবং সবচেয়ে সহজে দোষারোপ করা হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামিজদের। মার্কিন প্রতিবেদনগুলিতে দুর্নীতি এবং ক্যাথলিকদের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগগুলিতে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি ছিল ব্যাপক, কিন্তু সেটা এমন স্তরে ছিল না যেটি যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক অদক্ষ এবং অকার্যকর সামরিক ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনী খুব ভালভাবেই লড়াই করেছিল।’

যুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামের দুই লাখ থেকে আড়াই লক্ষ সৈন্য প্রাণ হারায়। অধ্যাপক ভু মনে করছেন, তাই দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য ভাল হতো যদি মার্কিন অস্ত্র এবং তহবিল দিয়ে হলেও তারা যুদ্ধ জয়ের জন্য সব কিছু করত।

অধ্যাপক ভু বলছেন, শেষ পর্যন্ত ওই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল সামগ্রিকভাবে এই যুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের ধরে উত্তর ভিয়েতনামের টিকে থাকার ক্ষমতা। যে প্রচেষ্টা দক্ষিণ ভিয়েতনামে দেখা যায়নি।

উত্তর ভিয়েতনামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বলতে বোঝাতো যে সে দেশের জনসাধারণ ওই যুদ্ধে বিশ্বাস করেছিল এবং হতাহতের বিষয় সম্পর্কে কম জানত।

অধ্যাপক ভু বলেন,‘কমিউনিস্টরা যেভাবে জনমত গঠন করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম সেভাবে পারেনি। জনশক্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও তারা সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। যার অর্থ আত্মঘাতী 'মানব তরঙ্গ' হামলার মতো সামরিক কৌশল উত্তর ভিয়েতনাম গ্রহণ করতে পেরেছিল, যেটা দক্ষিণ ভিয়েতনাম পারেনি।’

একইসাথে তিনি যোগ করে বলেন, আরো যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতি মার্কিন সমর্থনে ঘুণ ধরলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের তরফ থেকে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতি আর্থিক ও সামরিক সহায়তায় কোনো নড়চড় হয়নি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement