২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডেঙ্গু নিধনে সাভারে চলছে গবেষণা

-

দেশে প্রথম ডেঙ্গু ধরা পড়ে ২০০০ সালে। সেই থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭৬ জন। কিন্তু শুধু এ বছরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই আগের ১৮ বছরের মোট হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি প্রতিহতের জন্য এখন মশক নিধনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবাক করার বিষয় হলো ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা আছে। কিন্তু এ রোগ প্রতিরোধে কোনো টিকা নেই। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও কারো জানা নেই। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অনেক কারণ চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা, অসচেতনতা, এডিস মশা নিধনে ওষুধ কার্যকর না হওয়া, মশার প্রজননস্থলে নজরদারির অভাব, ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে জড়িতদের স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা না থাকা এবং যে পরিমাণে মশার জন্ম হচ্ছে সেই হারে মশা নিধন না হওয়ায় এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বিজ্ঞানীরা তাই এডিস মশার রূপান্তর ঘটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সমাধান খুঁজছেন। রূপান্তরিত মশা এডিসের বংশবিস্তারে বাধা সৃষ্টি করে। মশা রূপান্তরের এই আলোচনা ও কাজ বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে।
কিটতত্ত্ববিদ ও রোগতত্ত্ববিদদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এডিস মশা থাকলে ডেঙ্গু থাকবে। এডিস মশা একেবারে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব কাজ। এই ক্ষুদ্র কিট যদি ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করতে না পারে, তাহলে ডেঙ্গু অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশে রূপান্তরিত মশা অন্য প্রাণিজগতে কী প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছুই জানা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রী মশাকে বন্ধ্যা করলে সে আর ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে পারবে না। সাভারে এই গবেষণা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের সদস্যরা সেই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছেন। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিসকে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সংক্রমিত করতে পারলে সে আর ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হবে না।
সরকারের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পুরুষ এডিস মশাকে বন্ধ্যা করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার প্রকল্প নিয়েছে। ‘স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক’ (এসআইটি) নামের এই পদ্ধতি পরীক্ষাগারে সফল হয়েছে বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এসটিআই পদ্ধতিতে গামা রশ্মি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ পুরুষ এডিস মশাকে বন্ধ্যা করা হবে। সেই বন্ধ্যা পুরুষ মশা প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়া হবে। এসব পুরুষ মশা স্ত্রী এডিস মশার সাথে মিলিত হলে মশার ডিম নিষিক্ত হবে না। অনিষিক্ত ডিম থেকে এডিস মশার বংশবিস্তার হবে না। এডিস মশার বংশবিস্তার না হলে ডেঙ্গুও কমবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) তাদের ডেঙ্গুবিষয়ক নিউজ বুলেটিনে বলেছে, পুরুষ এডিস মশা মানুষকে কামড়ায় না, ডেঙ্গুর ভাইরাসও বহন করে না। তাই পুরুষ মশা প্রকৃতিতে অবমুক্ত করলে কোনো ক্ষতি নেই। এই পদ্ধতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে ভূমিকা রাখবে। এই পদ্ধতিটি মাঠপর্যায়ে প্রয়োগে পরমাণু শক্তি কমিশনকে কারিগরি সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের সদস্যরা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এডিস মশা যেমন ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্যাকটেরিয়া দিয়েও এর সংক্রমণ ঘটানো সম্ভব। ওলবাকিয়া নামের ব্যাকটেরিয়া যদি এডিস মশার শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মশার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ভাইরাসের বৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ হয়েছে। আইইডিসিআর বলছে, ওয়ার্ল্ড মস্কিউটো প্রোগ্রাম নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের ১২টি দেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ চলছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) একটি দিশারি প্রকল্পের মাধ্যমে এই পদ্ধতি ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই পদ্ধতির ব্যাখ্যা করার সময় আইসিডিডিআরবির পরামর্শক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন, প্রথমে এডিস মশাকে ওলবাকিয়া দ্বারা সংক্রমিত করা হয়। ওলবাকিয়া সংক্রমিত পুরুষ মশা স্ত্রী মশার সাথে মিলিত হলে অপরিস্ফুটনযোগ্য (যা থেকে মশা জন্মাতে পারে না) ডিম তৈরি হয়। অন্য দিকে স্ত্রী মশা ওলবাকিয়া সংক্রমিত হলে তার থেকে জন্ম নেয়া অন্য মশাও ওলবাকিয়া সংক্রমিত হয়েই জন্মাবে। এভাবে স্বাভাবিক এডিস মশার জায়গা দখল করে নেয় ওলবাকিয়া সংক্রমিত এডিস মশা।
আইইডিসিআর বলছে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক বাস্তু সংস্থানের কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কিটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল সম্প্রতি ঢাকা সফরের সময় সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেন, এ প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য খুবই দক্ষ জনবল, ভালো পরীক্ষাগার প্রয়োজন।
এসব বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন ওষুধ ব্যবহারের কথাও যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি শরীরে মাখার নানা ধরনের মলমের কথাও শোনা যাচ্ছে। যেকোনো প্রযুক্তি, ওষুধ বা মলম ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরুর আগে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন মশা বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। এই কিটতত্ত্ববিদ বলেন, মশকনিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তা জোরদার করতে হবে। মশা রূপান্তরের প্রকল্পগুলো শতভাগ সফলতার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়াল
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা: সানিয়া তহমিনা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু একটি এনডেমিক ডিজিজ। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক মানুষ মারা যান। তবে এটা এখন সারা বছরই থাকে। গত বছরও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (শীতের সময়) দেশে কিছু কিছু জায়গায় ডেঙ্গু রোগী ছিল। আর বাংলাদেশের তাপমাত্রা প্রায় সবসময়ই ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো থাকে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক ডা: মাহমুদুর রহমান বলেন, এটা আসলে হঠাৎ করে একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে বেড়েছে। গত বছর থেকেই ওষুধ কার্যকর ছিল না। একই সাথে গত বছর থেকে ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং এই রোগের সিভিয়ারিটি (জটিলতা) বেড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়েছে বলেও মনে করেন ডা: মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ যে শুধু বাংলাদেশেই তা নয়, বিশ্বের কয়েকটি দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। আর এর কারণ ডেঙ্গুর সেরোটাইপ (ধরন) বদলেছে।
চার ধরনের ডেঙ্গুর মধ্যে চলতি বছর এবং গত বছর ডেন টু, থ্রি এবং ফোরও টাইপের ডেঙ্গু পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা: এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এক কথায় বলব মশা নিধন হয়নি। যেভাবে মশার প্রজনন হয়েছে, সেভাবে মশা নিধন হয়নি বলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার এত বেশি।
আবার জলবায়ুকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া-বিষয়ক কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা: এম এম আক্তারুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, সাধারণ তাপমাত্রা যখন অনেক বেশি থাকে, বৃষ্টি যখন থেমে থেমে হয়, তখনকার আবহাওয়াটাই এডিস মশা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তাছাড়া যখন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলো, তখন মশার প্রজনন বন্ধ করতে যে সক্ষমতা দরকার তা আমাদের ছিল না। একই সাথে আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ছিল না বা এখনো সেটা পুরোপুরি তৈরি করা যায়নি।
ডা: এম এম আক্তারুজ্জামান দেশের বিভিন্ন নির্মাণাধীন এবং নির্মাণ হয়ে যাওয়া ভবনগুলোর ভুল নকশাকেও এডিস মশার প্রজননের জন্য দায়ী করেছেন। এসব ভবনের ওয়াসার লাইন, সুয়ারেজ লাইনের ডিজাইনে পরিকল্পনার অভাবকেও বড় কারণ বলে মনে হয়। এসব জায়গাতে এডিস মশা ডিম পারে। আবার রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, মেট্রোরেল প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সময় পরিবেশ নোংরা হওয়াকেও মশার প্রজনন বাড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement